পাতা:মৈমনসিংহ গীতিকা (প্রথম খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/২৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৷৹
মৈমনসিংহ-গীতিকা

৭। পূর্ব্ব-মৈমনসিংহের পল্লীগুলি ‘সাহিত্যিক তীর্থ’-পদবাচ্য

বাঙ্গালার মাটীর যে কি আকর্ষণ তাহা স্বভাবের খাঁটী সৃষ্টি এই গীতগুলির সর্ব্বত্র দৃষ্ট হইবে। বাঙ্গালার চাঁপা, বাঙ্গালার নাগেশ্বর ও কুমুদ ফুল, বাঙ্গালার কুটীরে কুটীরে কি সুন্দর দেখায়, এই সাহিত্যের পথে ঘাটে তাহার নিদর্শন আছে। বর্ষার কদম্ব বৃক্ষ, মান্দার গাছের ডালে-ঘেরা কদলী বন, নদীর ধারে কেয়া ফুলের ঝাড়, মুক্তাবর্ষী প্রস্রবণপ্রতি বৃহৎ তরুশাখা হইতে অজস্র বকুল ফুলের দান—কাব্যবর্ণিত কর্মশালার মাঝে মাঝে উঁকি মারিয়া আমাদের শ্রম অপনোদন ও চোখের তৃপ্তি ঘটাইয়া যায়। কোথাও বর্ণনার বাহুল্য নাই, অথচ কৃষকের দৃষ্টি যেরূপ কিছুতেই মাথার উপরকার আকাশ ও চোখের সামনের শ্যামল বনরাজি এড়াইতে পারে না, এই কাব্যসাহিত্যের নানা ঘটনার মধ্যে পারিপার্শ্বিক শোভাদৃশ্যগুলিও সেইরূপ পাঠকের অপরিহার্য্য সহচরস্বরূপ সঙ্গে সঙ্গে থাকিবে। বিশেষতঃ অনেক স্থলেই পূর্ববঙ্গের দৃশ্যাবলি মানসপটে মুদ্রিত হইয়া যায়। পূর্ববঙ্গের প্রচলিত ভাষায় পূর্ব্ববঙ্গের দৃশ্য কিরূপ স্পষ্ট হইয়া উঠে তাহার দু-একটি দৃষ্টান্ত দিব। চাঁদ বিনোদ ক্ষেত্রে ধান কাটিতে যাইতেছে, প্রথম ধানকাটার পরে বাতা নামক লতার ‘ডুগুল’ (অগ্রভাগ) দিয়া কৃষকেরা লক্ষ্মীর আসন তৈরী করে,—তাহাতে কয়েক গাছি ধানের ছড়া লক্ষ্মীদেবীকে সর্ব্ব প্রথম উৎসর্গ করা হয়। চাঁদ বিনোদ প্রথম দিন ধান কাটিতে যাইতেছে, দুটি ছত্রে কবি তাহার মূর্ত্তি আঁকিয়া দেখাইয়াছেন। “পঞ্চ গাছি বাতার ডুগুল হাতেতে লইয়া। মাঠের পানে যায় বিনোদ বারমাসী গাইয়া।” প্রথম ধান ঘরে আনার স্ফূর্ত্তি বারমাসী গানে ব্যক্ত হইতেছে। “গুরু গুরু ডাকে মেঘ জিল্‌কি ঠাডা পড়ে” ছত্রটিতে ‘জিল্‌কি’ ও ‘ঠাডা’ শব্দের দ্বারা বর্ষার তমসাচ্ছন্ন আকাশ হঠাৎ বিদ্যুৎস্ফুরণে কিরূপ ক্ষণতরে আলোকিত হইয়া যায, পূর্ববঙ্গবাসীর চক্ষে সেই চিরপরিচিত দৃশ্যের আভাস আনয়ন করিতেছে। ছেলে না খাইয়া বিদেশে যাইতেছে, অতি দুঃখে মাতা তাহার পথের প্রতি সজল দৃষ্টি বদ্ধ করিয়া আছেন। বাঁশের ঝাড় ও জঙ্গলের ডাল চাঁদ বিনোদের পৃষ্ঠদেশ ছুঁইতেছ,—এইভাবে পুত্র গভীর জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হইয়া পড়িল, মাতা চোখের জল মুছিতে মুছিতে গৃহে ফিরিলেন,—এইরূপ বহু দৃশ্যে বাঙ্গালার স্নিগ্ধ কুটীরটি আমাদের চক্ষে প্রত্যক্ষবৎ স্পষ্ট হইতেছে। “হাতেতে সোণার ঝাড়ি বর্ষা নেমে আগে”—কি সুন্দর পদ! তাহা হইতে অপূর্ব্ব ‘বৌ কথা কও’ পাখীর বর্ণনা। মাথায় বজ্র, অনবরত শ্রাবণের জলে সিক্ত দেহ,—সে দিকে দৃক্‌পাত নাই—পাখীটা কাঁদিয়া কাঁদিয়া পথে পথে ‘বৌ কথা কও’ বলিয়া অভিমানিনী প্রিয়তমার মান ভাঙ্গাইতে চেষ্টা পাইতেছে। “শাউনিয়া ধারা শিরে বজ্র ধরি মাথে। ‘বউ কথা কও’ বলি কাঁদে পথে