পাতা:মৈমনসিংহ গীতিকা (প্রথম খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/২৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৷৵৹
মৈমনসিংহ-গীতিকা

ঠাকুর বাড়ীর ভিটা এখন উচ্চ ভূখণ্ডে পরিণত; শুধু নামে মাত্র তাহাদের পরিচয়, জন- মানবশূন্য। হতভাগ্য ব্রাহ্মণ যুবরাজের স্মৃতিতে এখনও নিকটবর্ত্তী স্থানগুলি ভরপুর। জৈন্তা পাহাড়ের অদূরে কংস নদীর তীরভূমির রক্তিম পুষ্পারণ্য, যেখানে মহুয়া ও নদের চাঁদ কয়েক মাস বাস করিয়াছিলেন, সেই জঙ্গলময় দৃশ্য এখনও পর্যটকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কিশোরগঞ্জ সাব-ডিভিসনে বঙ্গীয় সাহিত্যিকদের আর-এক তীর্থ পাতুয়ারী গ্রাম, এইখানে দ্বিজবংশীদাস ও তাঁহার গুণবতী কন্যা চন্দ্রাবতী একত্রে “মনসার ভাসান" রচনা করিয়াছিলেন। চন্দ্রাবতী তপস্বিনী, সহসা চন্দ্রিকাভূষিত শারদাকাশের গায় যেরূপ বিদ্যুৎ চলিয়া যায়, এই পরম নিষ্ঠাবতী যোগশান্ত পূজারিণীর শুদ্ধ চিত্তে সেইরূপ একবার সাংসারিক প্রেমের একটা আকস্মিক লহরী খেলিয়া গিয়াছিল। নিরাশ জীবনকে শিবের পায়ে উৎসগ করিয়া চন্দ্রাবতী যে মন্দির নির্মাণ করাইয়াছিলেন, যাহার গাত্রে রক্ত মালতীফুলের রস দিয়া উন্মত্তবৎ জয়চন্দ্র তাঁহার শেষ নিবেদন অনলবর্ষী অনুতাপের ভাষায় লিখিয়া ফুলেশ্বরীর জলে ঝাঁপাইয়া পড়িয়া প্রাণ বিসর্জন দিয়াছিলেন,—সেই জরাজীর্ণ মন্দিরের অবশেষ নাকি ফুলেশ্বরীর তীরে এখনও বিদ্যমান। এই পাতুয়ারী গ্রামের পার্শ্বে ই ‘জালিয়ার হাওর’, এইখানে বংশীদাস দস্যু কেনারাম কর্তৃক আক্রান্ত হইয়াছিলেন এবং নলখাগড়ার বনাকীর্ণ এই হাওরেই বংশীদাসের কণ্ঠের অপূর্ব মনসাসঙ্গীতে প্রস্তরকঠিন দস্যুর মন গলিয়া গিয়াছিল। ফুলেশ্বরী নদীর গর্ভে অনুতপ্ত দস্যু তাহার বহুধৎসর-সঞ্চিত রত্নমাণিক্যপূর্ণ ঘড়াগুলি বিসর্জন দিয়া স্বীয় কোষনির্ম্মুক্ত অসিদ্বারা আত্মহত্যা করিতে চাহিয়াছিল।

 কেন্দুয়ার নিকটবর্তী বিপ্রগ্রাম (বিপ্রবর্গ) কবি কঙ্কের নিবাসভূমি, নেত্রকোণার দক্ষিণে। এই গ্রামের নিকটবর্তী রাজী (রাজেশ্বরী) নদীর তীরে কঙ্ক বাঁশী বাজাইয়া গরু চরাইতেন এবং যখন অপরাহ্ণে বিশীর্ণ পদ্মপ্রভ শ্রমকাতর মুখে গর্গাশ্রমে ফিরিয়া আসিতেন, তখন ফুল্ল নেত্রে দেখিতে পাইতেন, কুটীরবাসিনী লীলা উৎকণ্ঠায় তালপত্রের ব্যজনীহস্তে তাঁহার আগমন প্রতীক্ষা করিতেছেন। এই রাজী নদীর তীরে এক হস্তে লীলার চিতা জ্বালাইয়া অপর হস্তে চক্ষুজল মুছিতে মুছিতে গর্গ সহসা প্রত্যাগত কঙ্ককে দেখিয়া দাবদগ্ধ তরুর ন্যায় শোকে জ্বলিয়া উঠিয়াছিলেন এবং “মৃত্যুকালে তোমার নামই লীলার শেষ কথা” এই বলিতে বলিতে অধীর হইয়া পড়িয়াছিলেন। নেত্রকোণায় কংস নদীর দক্ষিণে বৃহৎ “বাঘরার হাওর” সোনাই-এর শোচনীয় মৃত্যুর কথার সঙ্গে অপরিহার্য্য রূপে সংশ্লিষ্ট। সোনাই-এর মত কত রূপসী সাধ্বীর সর্বনাশ করিয়া ‘বাঘরা’ এই বিস্তৃত বিলটি দেওয়ান সাহেবদের নিকট হইতে লাখেরাজ সর্ত্তে দান পাইয়াছিল, তাহারই নামে কলঙ্কিত হইয়া এই বিল এখনও পরিচিত। দীঘলহাটি গ্রামটির এখন অস্তিত্ব নাই, এই গ্রামের সন্নিহিত নদীর তীরে বিস্তৃত কেয়াবনের নিকট হইতে দেওয়ান ভাবনার নিযুক্ত লোকেরা রোরুদ্যমানা