পাতা:মৈমনসিংহ গীতিকা (প্রথম খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/৩২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৷৷৵৹
মৈমনসিংহ-গীতিকা

ও মহুয়ার স্মৃতি বহন করিতেছে। এখন তথায় কতকগুলি ভিটামাত্র পড়িয়া আছে। কিন্তু নিকটবর্ত্তী গ্রামসমূহে এই প্রণয়িযুগ্মের বিষয় লইয়া নানা কিংবদন্তী এখনও লোকের মুখে মুখে চলিয়া আসিতেছে। যে কাঞ্চনপুর হইতে “হোমরা” বেদে মহুয়াকে চুরি করিয়া লইয়া যায়—তাহা ধনু নদীর তীরে অবস্থিত ছিল। নেত্রকোণার অন্তর্গত সান্দিকোনা পোষ্টাফিসের অধীন মস্‌কা ও গোরালী নামক দুইটি গ্রাম আছে—মস্‌কা গ্রামের সেক আসক আলী ও উমেশচন্দ্র দে এবং গোরালীর নসুসেকের নিকট হইতে এই গানের অনেকাংশ সংগৃহীত হয়। মস্‌কা গ্রামে মহুয়ার পালা গাহিবার জন্য এখনও নাকি একটি দল আছে। সময়ে যে গাথা ইন্দ্রধ্বজের ন্যায় শত শত পল্লীর বক্ষস্থলে প্রতিষ্ঠিত ছিল, আজ তাহা একটা ভগ্নদণ্ডে পর্য্যবসিত। ১৯২১ খৃষ্টাব্দের ৯ই মার্চ্চ আমি চন্দ্রকুমারের নিকট হইতে এই গাথা পাইয়াছি। চন্দ্রকুমার দে যেভাবে গীতিটি পাঠাইয়াছিলেন, তাহাতে অনেক অসঙ্গতি ছিল, গোড়ার গান শেষে আর শেষের গান গোড়ায় এই ভাবে গীতিকাটি উলট-পালট ছিল, আমি যথাসাধ্য এই কবিতাগুলি পুনঃ পুনঃ পড়িয়া পাঠ ঠিক করিয়া লইয়াছি।

 এই গানের মোট ৭৫৫ ছত্র পাওয়া গিয়াছে, আমি তাহা ২৪টি অধ্যায়ে বিভক্ত করিয়া লইয়াছি। মহুয়ার গান পড়িয়া আমাদের ভূতপূর্ব্ব রাজপ্রতিনিধি লর্ড রোনাল্ডসে বিশেষ প্রীতি প্রকাশ করিয়াছেন।

 ২। মলুয়া—গ্রন্থকারের নাম নাই। গোড়ায় চন্দ্রাবতীর একটা বন্দনা আছে, এজন্য কেহ কেহ মনে করেন সমস্ত পালাটিই চন্দ্রাবতীর রচনা। আমার নিকট এই অনুমান সত্য বলিয়া মনে হয় না। চন্দ্রাবতী সম্ভবতঃ ১৬০০ খৃঃ অব্দ পর্য্যন্ত জীবিত ছিলেন। এই সময়ে জঙ্গলবাড়ীর দেওয়ান-বংশের প্রতিষ্ঠাতা ইশা খাঁ সবে মাত্র পূর্ব্ব-মৈমনসিংহে প্রভাব বিস্তার করিয়াছেন, তখনও “নজর তরপের ছেলেরা” আবির্ভূত হইয়া পরস্ত্রীহারক দস্যুর বৃত্তি অবলম্বন করেন নাই। আরও ১০০ বৎসর পরে এই ঘটনা হইয়াছিল বলিয়া আমার মনে হয়। জাহাঙ্গীর দেওয়ান কোন্ বংশসম্ভূত তাহা জানিবারও উপায় নাই। গীতি-বর্ণিত আরালিয়া গ্রাম ভাদৈর নদীর তীরবর্ত্তী এবং কিশোরগঞ্জ হইতে ২২ মাইল উত্তর-পূর্ব্বে; ইহারই ৪।৫ মাইল দূরে “সূত্যা” নদীর কূলে চাঁদ বিনোদের বাড়ী ছিল, সূত্যা নদী আরালিয়া হইতে ৪।৫ মাইল দূরে অবস্থিত। কিন্তু সেই গ্রামটির নাম নাই। ৯৬ পৃষ্ঠায় (১১ ছত্র) “বংশাইয়া সতী কন্যা হইল অবতার” পদটির “বংশাইয়া” শব্দটিতে গ্রামের নাম বুঝাইতে পারে, “বংশাইয়া” শব্দের ভিন্নার্থ (অর্থাৎ “সেই বংশে”) হওয়াও অসম্ভব নয়। বংশাইয়া নামক কোন গ্রাম আরালিয়ার নিকটে নাই, কিন্তু উক্ত গ্রামের ৪।৫ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে “বক্‌শাইয়া” নামক এক গ্রাম আছে। লিপিকারগণ অজানিত দেশের নাম লইয়া প্রায় লিখিতে ভুল করিয়া থাকেন, সুতরাং ‘বক্‌শাইয়া’র ‘বংশাইয়া’-রূপ-গ্রহণ আশ্চর্য্য নহে। গীতোক্ত