পাতা:মৈমনসিংহ গীতিকা (প্রথম খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/৩৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ভূমিকা
১৸৴৹

করিয়াছিলেন, তাহা ঠিক বলিতে পারি না। তবে রঘুসুত কবি যিনি ইঁহার সঙ্গে “কঙ্ক ও লীলা” লিখিয়াছিলেন, তিনি ২৫০ বৎসর পূর্ব্বে জীবিত ছিলেন। রঘুসুতের বংশলতায় এই অনুমান সমর্থিত হয়। পাতুয়ারী গ্রামটি কিশোরগঞ্জ হইতে বেশী দূরে নহে। এই গাথাটির ছত্রসংখ্যা মোট ৩৫৪। ইহাকে আমরা ১২ অঙ্কে বিভাগ করিয়া লইয়াছি।

 ৪। কমলা—ভণিতায় কবির নাম দ্বিজ ঈশান পাওয়া যাইতেছে। ‘হুলিয়া’ নামক কোন গ্রাম পূর্ব্ব-মৈমনসিংহে পাইলাম না। তবে “হালিয়ারা” গ্রামটি নন্দাই হইতে বেশী দূরে নহে। এই হালিয়ারার নিকটে রঘুপুর আছে। এই হালিয়ারা ‘হুলিয়া’ হইতে পারে, কিন্তু পুলিশ ইনস্পেক্টর শ্রীযুক্ত কালীপ্রসাদ মল্লিক মহাশয় বলিতেছেন, মৈমনসিংহ সদর সাব-ডিভিসনের অন্তর্গত হালিয়াঘাট নামক স্থানই খুব সম্ভব কাব্যবর্ণিত হুলিয়া। কারণ তাহার পার্শ্ববর্ত্তী বৃহৎ জঙ্গলে বিস্তৃত রাজবাড়ী ও গড়খাই প্রভৃতির চিহ্ন আছে, ২।৩ শত বর্ষ পূর্ব্বে তথায় কেশররায় নামক এক রাজবৈভবশালী ব্যক্তি বাস করিতেন। তাঁহার বিধবারমণী শত্রু কর্তৃক গৃহ আক্রান্ত হইলে প্রাসাদসংলগ্ন দীঘির জলে প্রাণত্যাগ করেন। এই কেশররায় “দয়াল রাজা”র বংশধর হইতে পারেন। কেন্দুয়ার নিকটবর্ত্তী কোন গ্রামবাসিনী তিন-চারটি রমণীর নিকট হইতে চন্দ্রকুমার এই গাথাটি সংগ্রহ করিয়াছিলেন। ইহা বাঙ্গালা ১৩২৮ সনের ১৯শে আষাঢ় আমার হস্তগত হয়। আমি গাথাটিকে ১৭ অঙ্কে ভাগ করিয়াছি, ছত্রসংখ্যা মোট ১৩২০।

 ৫। দেওয়ান ভাবনা—দেওয়ানদের অত্যাচারের কথা যে সকল গীতিকায় বর্ণিত আছে, তাহাদের কোনটিতেই কবির নাম পাওয়া যায় না। এ সম্বন্ধে কবিদের সতর্কতা অকারণ নহে।

 দেওয়ান ভাবনা মোট ৩৭৪টি ছত্রে সম্পূর্ণ,—আমি গানটিকে ৯ অঙ্কে ভাগ করিয়াছি। এই গীতিকা ২০০।২৫০ বৎসর পূর্ব্বে রচিত হইয়াছিল বলিয়া অনুমান করা যায়। গীতি-বর্ণিত “বাঘরা’র নামে তদঞ্চলের সুপ্রসিদ্ধ একটি হাওর পরিচিত। প্রবাদ এই, সোনাই-এর মত বহু সুন্দরীর সন্ধান দেওয়ার পুরস্কারস্বরূপ বাঘরা নামক এক গুপ্তচর (‘সিন্ধুকী’) দেওয়ানদের নিকট হইতে এই বিস্তৃত ‘হাওর’ লাখেরাজস্বরূপ পুরস্কার পাইয়াছিল। ‘বাঘরার হাওর’ নেত্রকোণার দশমাইল দক্ষিণ-পূর্বে। বোধ হয় ‘দীঘলহাটী’ গ্রামের অস্তিত্ব লুপ্ত হইয়াছে। কিন্তু উক্ত হাওরের নিকটবর্ত্তী ‘ধলাই’ নদীর তীরে ‘দেওয়ানপাড়া’ নামক একটি গ্রাম আছে,—সম্ভবতঃ এইখানেই ‘দেওয়ান ভাবনা’র আবাস ছিল।

 ‘দেওয়ান ভাবনা’ ১৯২২ খৃঃ অব্দের সেপ্টেম্বর মাসে চন্দ্রকুমার দে আমাকে সংগ্রহ করিয়া পাঠাইয়াছিলেন। কেন্দুয়ার নিকটবর্তী কোন কোন স্থানের মাঝিদের মুখে এই গান তিনি শুনিয়াছিলেন। নৌকা-‘বাছ’ দেওয়ার সময়ে এখনও তাহারা এই গান গাহিয়া থাকে।