পাতা:মৈমনসিংহ গীতিকা (প্রথম খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/৩৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ভূমিকা
২৴৹

একলক্ষ টাকা ব্যয়ে সংগৃহীত হইয়াছে, আমি পঁচিশ হাজার টাকায় তদপেক্ষা বেশী কাজ দেখাইতে পারি।

 মৈমনসিংহবাসিগণ কলিকাতায় একটি সভা আহ্বান করিয়া এই গাথাগুলি সম্বন্ধে তাঁহাদের কর্ত্তব্য কি তাহা জানাইবার জন্য আমাকে আহ্বান করিয়াছিলেন, আমি সুদীর্ঘ বক্তৃতা করিয়া তাহা বুঝাইতে চেষ্টা করিয়াছিলাম ও আপাততঃ কাজ চালাইবার মতন দশ হাজার টাকা চাহিয়াছিলাম। সেই সভার সভাপতি ছিলেন সন্তোষের রাজা শ্রীযুক্ত মন্মথনাথ রায় চৌধুরী। আমি সভা হইতে আশ্বাস পাইয়াছিলাম যে, শীঘ্রই এই টাকা সংগৃহীত হইবে। কিন্তু ঝুলি কাঁধে করিয়া দুয়ারে দুয়ারে বাহির না হইলে ভিক্ষা জোটে না। আমি রোগের দরুন বিছানায় পড়িয়া আছি, আমি ভিক্ষুক সাজিয়া বড় মানুষের বাড়ীতে বাড়ীতে যাইয়া হাত পাতিতে অক্ষম। বিশেষতঃ আমি মৈমনসিংহবাসিগণের নিকট ভিক্ষা চাহিতে লজ্জা বোধ করি, সেখানে কি আমার কোন দাবীই নাই?

 আমি মৃত্যুশয্যায় পড়িয়া খাটিয়া খাটিয়া দেহপাত করিয়াছি। ইংরাজী খণ্ডের ভূমিকা পাঠ করিলে আপনারা তাহা জানিতে পারিবেন, আমি নিজ হইতেও যথাসাধ্য খরচ করিতে কুণ্ঠিত হই নাই—কিন্তু তজ্‌জন্য আমি কোন পুরস্কারের দাবী করিতেছি না। কর্ম্মে সফলতাই আমার পুরস্কার, এই পালাগানগুলি দেশ-বিদেশে আদর পাইতেছে। প্রুফ দেখাইতে যে সকল সাহেবের নিকট গিয়াছি, তাঁহাদের মধ্যে কেহ কেহ পড়িতে পড়িতে ঘন ঘন রুমাল দিয়া চোখ মুছিয়াছেন। সেই চোখের জলের মত পুরস্কার আমি আর কোথায় পাইব? যেদিন ষ্টেলা ক্র্যামরিচ মহুয়া গল্পটি পড়িয়া আমাকে লিখিলেন, “সারাদিন জ্বরের ঘোরে আমি মহুয়া, নদের চাঁদ ও হোমরাকে যেন স্বপ্নের মত দেখিয়াছি। আমি ভারতীয় সাহিত্য যতটা পড়িয়াছি, তাহার মধ্যে এমন মর্ম্মস্পর্শী, এমন সহজ সুন্দর কোন আখ্যান পড়ি নাই,” সেই দিন আমি আমার প্রাণান্ত পরিশ্রমের পুরস্কার পাইয়াছি। আর যখন আমি মহামনা লর্ড রোনাল্ডসকে লিখিয়াছিলাম, “আপনি দুটি মাত্র ছত্র লিখিয়া দিন, আমার পুস্তকখানি সেই রাজসম্মান মলাটের পুরোভাগে লইয়া প্রকাশিত হইবে।” তদুত্তরে তিনি লিখিলেন, “এই পালাগানগুলি এত চমৎকার যে, দুটি ছত্র লিখিয়া আমি কিছুতেই তৃপ্ত হইতে পারি না।” একটি সংক্ষিপ্ত ভূমিকা লিখিয়া পুস্তকখানিকে অলঙ্কৃত করিলেন; সেই দিন কি আমি পরিশ্রমের যথেষ্ট পুরস্কার পাই নাই? সর্ব্বশেষ যখন পুস্তকখানি হাতে লইয়া আশুতোষ তাঁহার সমস্ত প্রাণভরা সন্তোষের হাসিতে স্বীয় গুম্ফ পর্য্যন্ত উজ্‌জ্বল ও অলঙ্কৃত করিয়া আমার দিকে প্রসন্ন চোখে চাহিলেন,—পালাগানের ভাষায় বলিতে গেলে “পুন্নমাসী চাঁদ যেমন দেখায় নদীর তলা” সেইরূপ তাঁহার হৃদয়ের আনন্দ সেই হাসিতে নিঃশেষভাবে ধরা পড়িয়া গেল, তখন আমি যে গৌরব পাইলাম, কোন্ স্বর্ণ পদক তাহা আমাকে দিতে পারিত?

E—1918 B.T.