পাতা:য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২১২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র

রাত যদি কাজে ব্যস্ত থাকে, তবু মদনের ফুলশরের তহবিল এখেনে দেউলে হবার কোনো সম্ভাবনা নেই— এত ফুল! যেখানে সেখানে পথে ঘাটে ফুল। ফুল মাড়িয়ে চলতে হয়। আমরা রোজ পাহাড়ে বেড়াতে যাই। গোরু চরছে, ভেড়া চরছে। এক-এক জায়গায় রাস্তা এত ঢালু যে, উঠতে নাবতে কষ্ট হয়। এক-এক জায়গা খুব সংকীর্ণ পথ, দু ধারে গাছ উঠে আঁধার করে আছে, ওঠবার সুবিধের জন্যে জায়গায় জায়গায় ভাঙা ভাঙা সিঁড়ির মতন আছে, পথের মধ্যেই লতাগুল্ম উঠেছে, ফুল ফুটে রয়েছে। চার দিকে এমন মধুর রোদ‍্দুর (হাসছ কী! রোদ‍্দুর মধুর হতে পারে কিনা এখেনে এসে একবার দেখে যাও দিকি!)— এত অগণ্য ফুল যে মনের মধ্যে বসন্ত জেগে ওঠে, মলয় বাতাস বইতে থাকে। এখানকার বাতাস বেশ গরম! ভারতবর্ষ মনে পড়ে। এইটুকু গরমেই লন‍্ডনের প্রাণীদের চেয়ে এখানকার জীবজন্তুদের কত নির্জীব ভাব প্রত্যক্ষ করা যায়। ঘোড়াগুলো আস্তে আস্তে যাচ্ছে, মানুষগুলোর তেমন ভারী ব্যস্ত ভাব নেই, গড়িমসি করে চলেছে। আমি আজ কাল এমন আলস্যচর্চায় ব্যস্ত আছি যে তোমাদের একটু ভালো করে চিঠি লেখবার সময় পেয়ে উঠি নে। দিনের মধ্যে তিন শো হাই উঠছে, এক-একটা বই খুলছি ও তার ওপরে আধ ঘণ্টা চোখ বুলিয়ে দু ঘণ্টা চোখ বোজবার বন্দোবস্ত করে নিচ্ছি, দোয়াতে কলম ডুবিয়ে কালী তুলে লেখা সমুদ্রমন্থনের মতো একটা ঘোরতর ব্যাপার বলে মনে হচ্ছে, চোখের পাতা ফেলতে ও নিশ্বাস প্রশ্বাস নিতে পরিশ্রম বোধ হচ্ছে। তুমি এখেনে এলে বড়ো আরামেই থাকো। এখানকার মতো দৃশ্য, নদীর ধার, মাঠ, পড়বার বই, গল্প করবার সময়, গান করবার নির্জনতা, পরনিন্দা করবার অবসর আর যদি কোথাও আছে!

১৯২