পাতা:য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি

 এমন সময় হঠাৎ দেখা গেল অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। বহুকালের যে ব্রহ্মত্রটুকু পাওয়া গিয়েছিল তার ভালো দলিল দেখাতে পারি নি বলে নূতন রাজার রাজত্বে বাজেয়াপ্ত হয়ে গেছে। হঠাৎ আমরা গরিব। পৃথিবীর চাষারা যে রকম খেটে মরছে এবং খাজানা দিচ্ছে আমাদেরও তাই করতে হবে। পুরাতন জাতিকে হঠাৎ নূতন চেষ্টা আরম্ভ করতে হয়েছে।

 অতএব চিন্তা রাখো, বিশ্রাম রাখো, গৃহকোণ ছাড়ো, ব্যাকরণ ন্যায়শাস্ত্র শ্রুতিস্মৃতি এবং নিত্যনৈমিত্তিক গার্হস্থ্য নিয়ে থাকলে আর চলবে না; কঠিন মাটির ঢেলা ভাঙো, পৃথিবীকে উর্বরা করো এবং নব মানব-রাজার রাজস্ব দাও; কালেজে পড়ো, হোটেলে খাও এবং আপিসে চাকরি করো।

 উঠেছি তো, চলেওছি, দেখাচ্ছি আমরা খুব কাজের লোক―কিন্তু ভিতরে ভিতরে কতটা নিরাশ্বাস, কতটা নিরুদ্যম!

 হায়, ভারতবর্ষের পুরপ্রাচীর ভেঙে ফেলে এই অনাবৃত বিশাল কর্মক্ষেত্রের মধ্যে আমাদের কে এনে দাঁড় করালে! আমরা চতুর্দিকে মানসিক বাঁধ নির্মাণ ক’রে, কালস্রোত বন্ধ করে দিয়ে, সমস্ত নিজের মনের মতো গুছিয়ে নিয়ে বসে ছিলুম। চঞ্চল পরিবর্তন ভারতবর্ষের বাহিরে সমুদ্রের মতো নিশিদিন গর্জন করত, আমরা অটল স্থিরত্বের মধ্যে প্রতিষ্ঠা লাভ করে গতিশীল নিখিল সংসারের অস্তিত্ব বিস্মৃত হয়ে বসেছিলুম। এমন সময়ে কোন্ ছিদ্রপথ দিয়ে চির-অশান্ত মানবস্রোত আমাদের মধ্যে প্রবেশ করে সমস্ত ছারখার করে দিলে! পুরাতনের মধ্যে নূতন মিশিয়ে, বিশ্বাসের মধ্যে সংশয় এনে, সন্তোষের মধ্যে দুরাশার আক্ষেপ উৎক্ষিপ্ত করে দিয়ে সমস্ত বিপর্যস্ত করে দিলে!

 মনে করো আমাদের চতুর্দিকে হিমাদ্রি এবং সমুদ্রের বাধা যদি আরও দুর্গম হত তা হলে একদল মানুষ একটি অজ্ঞাত নিভৃত