পাতা:য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৮১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি

কাছে সেই কম্পিত দীপশিখা যেন ভাসমান সন্তানদের জন্যে ভূমিমাতার আশঙ্কাকুল জাগ্রত দৃষ্টি।

 তখন আমার হৃদয়ের মধ্যে ঐ গানটা ধ্বনিত হতে লাগল—

‘সাধের তরণী আমার কে দিল তরঙ্গে।’

 জাহাজ বােম্বাই বন্দর পার হয়ে গেল।―

ভাসল তরী সন্ধেবেলা,  ভাবিলাম এ জলখেলা,
মধুর বহিবে বায়ু― ভেসে যাব রঙ্গে।

কিন্তু সী-সিক্‌নেসের কথা কে মনে করেছিল!

 যখন সবুজ জল ক্রমে নীল হয়ে এল এবং তরঙ্গে তরীতে মিলে গুরুতর আন্দোলন উপস্থিত করে দিলে, তখন দেখলুম সমুদ্রের পক্ষে জলখেলা বটে, কিন্তু আমার পক্ষে নয়।

 ভাবলুম এই বেলা মানে মানে কুঠরির মধ্যে ঢুকে কম্বলটা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়িগে। যথাসত্বর ক্যাবিনের মধ্যে প্রবেশ করে কাঁধ হতে কম্বলটি একটি বিছানার উপর ফেলে দরজা বন্ধ করে দিলুম। ঘর অন্ধকার। বুঝলুম, আলাে নিবিয়ে দিয়ে দাদা তাঁর বিছানায় শুয়েছেন। শারীরিক দুঃখ নিবেদন করে একটুখানি স্নেহ উদ্রেক করবার অভিপ্রায়ে জিজ্ঞাসা করলুম, ‘দাদা, ঘুমিয়েছেন কি?’ হঠাৎ নিতান্ত বিজাতীয় মােটা গলায় কে-একজন হুহুঙ্কার দিয়ে উঠল, ‘হূজ দ্যাট!’ আমি বললুম, ‘বাস্‌রে! এ তাে দাদা নয়!’ তৎক্ষণাৎ বিনীত অনুতপ্ত স্বরে জ্ঞাপন করলুম, ‘ক্ষমা করবেন, দৈবক্রমে ভুল কুঠরিতে প্রবেশ করেছি।’ অপরিচিত কণ্ঠ বললে, ‘অল রাইট!’ কম্বলটি পুনশ্চ তুলে নিয়ে কাতরশরীরে সংকুচিতচিত্তে বেরােতে গিয়ে দেখি দরজা খুঁজে পাই নে। বাক্স তােরঙ্গ লাঠি বিছানা প্রভৃতি বিচিত্র জিনিসের মধ্যে খট্ খট্ শব্দে হাৎড়ে বেড়াতে লাগলুম। ইঁদুর কলে পড়লে তার মানসিক ভাব কিরকম হয়

৬৫