পাতা:য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৮৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি

ক্যাবিনের ভৃত্যটিকে ডেকে দিলেন। তাকেও আবার একে একে সমস্ত ঘটনাটি খুলে বলতে হল। প্রথমে সে কিছুই বুঝতে পারলে না, মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। সে বেচারার দোষ দেওয়া যায় না। তার জীবনের অভিজ্ঞতায় নিঃসন্দেহ এ রকম ঘটনা আর কখনো ঘটে নি, সুতরাং শোনবামাত্রই ধারণা হওয়া কিছু কঠিন বটে। অবশেষে বন্ধুতে আমাতে মিলে যখন অনেকটা পরিষ্কার করে বোঝানো গেল, তখন সে ধীরে ধীরে সমুদ্রের দিকে একবার মুখ ফেরালে এবং ঈষৎ হাসলে— তার পর চলে গেল। কম্বলের কাহিনী অনতিবিলম্বেই সমাপ্ত হল।

 কিন্তু সী-সিক্‌নেস ক্রমশঃ বৃদ্ধি পেতে লাগল। সে ব্যাধিটার যন্ত্রণা অনভিজ্ঞ স্থলচরদের কিছুতে বোঝনো যেতে পারে না। নাড়ীতে ভারতবর্ষের অন্ন আর তিলমাত্র অবশিষ্ট রইল না। য়ুরোপে প্রবেশ করবার পূর্বে সমুদ্র এই দেহ হতে ভারতবর্ষটাকে যেন ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে একেবারে সাফ করে ফেলবার চেষ্টা করছে। ক্যাবিনে চার দিন পড়ে আছি।

 ২৬ আগস্ট্। শনিবার থেকে আর আজ এই মঙ্গলবার পর্যন্ত কেটে গেল। জগতে ঘটনা বড়ো কম হয় নি— সূর্য চারবার উঠেছে এবং তিনবার অস্ত গেছে, বৃহৎ পৃথিবীর অসংখ্য জীব দম্ভধাবন থেকে দেশ-উদ্ধার পর্যন্ত বিচিত্র কর্তব্যের মধ্যে দিয়ে তিনটে দিন মহা ব্যস্তভাবে অতিবাহিত করেছে— জীবনসংগ্রাম, প্রাকৃতিক নির্বাচন, আত্মরক্ষা, বংশরক্ষা প্রভৃতি জীবরাজ্যের বড়ো বড়ো ব্যাপার সবেগে চলছিল―কেবল আমি শয্যাগত জীবন্‌মৃত হয়ে পড়ে ছিলুম। আধুনিক কবিরা কখনও মুহূর্তকে অনন্ত কখনও অনন্তকে মুহূর্ত আখ্যা দিয়ে প্রচলিত ভাষাকে নানাপ্রকার বিপরীত ব্যায়ামবিপাকে প্রবৃত্ত করান। আমি আমার এই চারটে দিনকে বড়ো

৬৮