পাতা:যোগাযোগ- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
যোগাযোগ

 বংশের দুর্গতির জন্য নিজেকে যতই অপরাধী করে, ততই হৃদয়ের সুধাপাত্র উপুড় ক’রে ভাইদের ওর ভালােবাসা দেয়— কঠিন দুঃখে নেংড়ানো ওর ভালোবাসা। কুমুর ’পরে তাদের কর্তব্য করতে পারছে না বলে ওর ভাইরাও বড়ো ব্যথার সঙ্গে কুমুকে তাদের স্নেহ দিয়ে ঘিরে রেখেছে। এই পিতৃমাতৃহীনাকে উপরওয়ালা যে স্নেহের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করেছেন ভাইরা তা ভরিয়ে দেবার জন্যে সর্বদা উৎসুক। ও যে চাঁদের আলোর টুকরাে, দৈন্যের অন্ধকারকে একা মধুর করে রেখেছে। যখন মাঝে মাঝে দুর্ভাগ্যের বাহন বলে নিজেকে সে ধিক্কার দেয়, দাদা বিপ্রদাস হেসে বলে, কুমু, তুই নিজেই তো আমাদের সৌভাগ্য— তােকে না পেলে বাড়িতে শ্রী থাকত কোথায়?”

 কুমুদিনী ঘরে পড়াশুনা করেছে। বাইরের পরিচয় নেই বললেই হয়। পুরােনাে নতুন দুই কালের আলাে-আঁধারে তার বাস। তার জগৎটা আবছায়া— সেখানে রাজত্ব করে সিদ্ধেশ্বরী, গন্ধেশ্বরী, ঘেঁটু, ষষ্ঠী; সেখানে বিশেষ দিনে চন্দ্র দেখতে নেই; শাঁখ বাজিয়ে গ্রহণের কুদৃষ্টিকে তাড়াতে হয়, অম্বুবাচীতে সেখানে দুধ খেলে সাপের ভয় ঘোচে; মন্ত্র প’ড়ে, পাঁঠা মানত ক’রে, সুপুরি আলো-চাল ও পাঁচ পয়সার শিন্নি মেনে, তাগাতাবিজ প’রে,সে জগতের শুভ-অশুভের সঙ্গে কারবার; স্বস্ত্যয়নের জোরে ভাগ্য সংশোধনের আশা— সে-আশা হাজারবার ব্যর্থ হয়। প্রত্যক্ষ দেখা যায় অনেক সময়েই শুভলগ্নের শাখায় শুভফল ফলে না, তবু বাস্তবের শক্তি নেই প্রমাণের দ্বারা স্বপ্নের মােহ কাটাতে পারে। স্বপ্নের জগতে বিচার চলে না, একমাত্র চলে মেনে-চলা। এ-জগতে দৈবের ক্ষেত্রে যুক্তির সুসংগতি, বুদ্ধির কর্তৃত্ব, ভালাে-মন্দর নিত্যতত্ত্ব নেই বলেই কুমুদিনীর মুখে এমন একটা করুণা। ও জানে, বিনা অপরাধেই ও লাঞ্ছিত। আট বছর হল সেই লাঞ্ছনাকে একান্ত সে নিজের বলেই গ্রহণ করেছিল— সে তার পিতার মৃত্যু নিয়ে।

১৪