পাতা:রক্তকরবী - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৫৮৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

©Ꮈ☾ হয়। MS. 135-পাণ্ডুলিপির কিছু অংশ যেভাবে কেটে দেওয়া হয়েছে, তাতে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, রবীন্দ্রনাথ এই অনুলিপিটি আদ্যোপান্ত পড়েই সেই অংশগুলি বর্জন করেছিলেন। দুটি খসড়ার পাঠ মিলিয়ে দেখলেই তাদের পার্থক্য বোঝা যাবে। দ্বিতীয় খসড়াটির পাঠ এইরকম : “আজ আপনাদের এই বারোয়ারি সভায় পালা অভিনয়ের জন্যে আমাকে ডাক পড়েচে, কখনো ডাকেন না, এবারে কি কারণে কৌতুহল হয়েচে । আপনাদের মতো ক্ষমতাশালী লোকদের কৌতুহলকে আমি ডরাই! আমার বিশ্বাস, পালা সাঙ্গ হলে আপনাদের কাছে ভিখ মিলবে না, কৌতুক করে কুত্তা লেলিয়ে দেবেন। তারা পালাটাকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করবার চেষ্টা করবে ! আমার এক ভরসা কোথাও দস্তস্ফুট করতে পারবে না। আপনারা আজ এখানে অনেকেই আছেন প্রবীণ ; অতএব স্বভাবতই আপনারা সন্দেহ করবেন আমার এই পালার মধ্যে একটি গুঢ় অর্থ আছে। । যদি থাকে সেটা গুঢ়ই থাক। তার প্রতি দৃষ্টিপাত না করলেই হল। রামায়ণের দশমুণ্ড বিশহাত রাবণ স্বর্ণলঙ্কায় রাজত্ব করেন আর সেই লঙ্কার মহৈশ্বৰ্য্যে সামান্য একটি বন্যবানর ল্যাজে করে আগুন লাগায়, এই কাহিনীটি কবিগুরু যদি আজকের এই সভায় উপস্থিত করতেন তাহলে নিশ্চয়ই গুঢ় অর্থ নিয়ে আপনাদের চণ্ডীমণ্ডপে একটা হলহলা উঠত ; ভয় করতেন কোনো একটা সুপ্রতিষ্ঠিত বিধিব্যবস্থাকে বুঝি বিদ্রুপ করা হচ্ছে ; তাঁর দাড়িটা আস্ত নিয়ে বৃদ্ধকবির তমসাতীরে ফিরে যাওয়া কঠিন হত। অথচ আজ হাজার হাজার বছর ধরে দেখা গেল। গৃঢ় অর্থ গুঢ়ই রয়ে গেল। সন্দিগ্ধ লোকেরা নিঃসংশয়ে রামায়ণের রসভোগ করে এলেন । যদি কৃপণতা না করে আমার পালার প্রধান রাজাটির দেহে অনেকগুলি মুণ্ড ও অনেকগুলো হাত বসিয়ে দিতে পারতুম তাহলে আমার মনের মতো হত, কিন্তু বৈজ্ঞানিক কলিযুগে আমার এতটা সাহস হয় না। ত্রেতাযুগের রাবণ হাতমুখের বাহুল্য নিয়ে যেসব কাণ্ড করতেন, আমার পাত্রটি বৈজ্ঞানিক শক্তির দ্বারা ততোধিক কাণ্ড করে থাকেন নাটকে এমন কথার আভাস আছে। আমার এই আধুনিক বিজ্ঞানবিশারদের মতই ত্রেতাযুগের রাবণ বিদ্যুৎ বজ্রধারীদের দ্বারে বেঁধে বরাবর তাদের দিয়ে আপনার ঘরের কাজ করিয়ে নিতে পারত ; কিন্তু তার সমৃদ্ধির মাঝখানে একটি রাজকন্যা এসে দাঁড়ালেন ; তখনি ধৰ্ম্ম জেগে করলেন। আমার নাটকে ঠিকটি এমন ঘটনা ঘটে নি কিন্তু এর মধ্যেও মানবকন্যার আবির্ভাব আছে। তাছাড়া কলিযুগের রাক্ষসদের সঙ্গে কলিযুগের বানরদের যে একটা যুদ্ধ ঘটবে সব শেষে তার সূচনা আছে। আদিকবির সাতকাণ্ডের মধ্যে স্থানাভাব ছিল না এই কারণে লঙ্কাপুরীতে তিনি রাবণ ও বিভীষণ উভয়কে স্বতন্ত্র মহল দিয়েছিলেন। আমার স্বল্পায়তন নাট্যটিতে রাবণের বর্তমান প্রতিনিধিটি এক দেহেই রাবণ ও বিভীষণ । বাল্মীকির রামায়ণকে, তার ভক্ত পাঠকেরা সত্যমূলক বলে স্বীকার করে থাকেন। আমার পালাটিকে যাঁরা শ্রদ্ধা করে শুনবেন তাঁরা জানবেন এটিও সত্যমূলক। ঐতিহাসিকের পরে তার প্রমাণ সংগ্রহের ভার দিলে পাঠকরা ঠকবেন। এইটুকু বললেই যথেষ্ট হবে যে কবির জ্ঞানবিশ্বাসমতে এটি সত্য ।