পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/১৮৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ঘরে-বাইরে ›ማ : সকলেরই অপ্রিয় হয়েছি। দেশের লোক ভাবছে আমি খেতাব চাই কিংবা পুলিসকে ভয় করি ; পুলিস ভাবছে ভিতরে আমার কুমতলব আছে বলেই বাইরে আমি এমন ভালোমানুষ। তবু আমি এই অবিশ্বাস ও অপমানের পথেই চলেছি। কেননা, আমি এই বলি, দেশকে সাদাভাবে সত্যভাবে দেশ বলেই জেনে, মাহুষকে মানুষ বলেই শ্রদ্ধা ক'রে, যারা তার সেবা করতে উৎসাহ পায় না, চীৎকার করে মা বলে দেবী বলে মন্ত্র পড়ে যাদের কেবলই সম্মোহনের দরকার হয় তাদের সেই ভালোবাসা দেশের প্রতি তেমন নয়, যেমন নেশার প্রতি । সত্যেরও উপরে কোনো একটা মোহকে প্রবল করে রাখবার চেষ্ট। এ আমাদের মজাগত দাসত্বের লক্ষণ । চিত্তকে মুক্ত করে দিলেই আমরা আর বল পাই নে। হয় কোনো কল্পনাকে, নয় কোনো মানুষকে, নয় ভাটপাড়ার ব্যবস্থাকে আমাদের অসাড় চৈতন্তের পিঠের উপর সওয়ার করে না বসালে সে নড়তে চায় না । যতক্ষণ সহজ সত্যে আমরা স্বাদ পাই নে, যতক্ষণ এইরকম মোহে আমাদের প্রয়োজন আছে, ততক্ষণ বুঝতে হবে স্বাধীনভাবে নিজের দেশকে পাবার শক্তি আমাদের হয় নি। ততক্ষণ, আমাদের অবস্থা যেমনি হ’ক, হয় কোনো কাল্পনিক ভূত, নয় কোনো সত্যকার ওঝা, নয় একসঙ্গে দুইয়ে মিলে, আমাদের উপর উৎপাত করবেই। সেদিন সন্দীপ আমাকে বললে, তোমার অন্য নানা গুণ থাকতে পারে কিন্তু তোমার কল্পনাবৃত্তি নেই,—সেইজন্যেই স্বদেশের এই দিব্যমূর্তিকে তুমি সত্য করে দেখতে পার না। দেখলুম বিমলও তাতে সায় দিলে। আমি আর উত্তর করলুম না। তর্কে জিতে মুখ নেই। কেননা এ তো বুদ্ধির অনৈক্য নয়, এ যে স্বভাবের ভেদ । ছোটো ঘরকন্নার সীমাটুকুর মধ্যে এই ভেদ ছোটো আকারেই দেখ দেয় সেই জন্যে সেটুকুতে মিলনগানের তাল কেটে যায় না। বড়ো সংসারে এই ভেদের তরঙ্গ বড়ে—সেখানে এই তরঙ্গ কেবলমাত্র কলধ্বনি করে না, আঘাত করে । কল্পনাবৃত্তি নেই ? অর্থাৎ আমার মনের প্রদীপে তেলবাতি থাকতে পারে কেবল শিখার অভাব ! আমি তো বলি সে-অভাব তোমাদেরই। তোমরা চকমকি পাথরের মতো আলোকহীন, তাই এত ঠুকতে হয় এত শব্দ করতে হয় তবে একটু একটু ফুলিঙ্গ বেরোয়—সেই বিচ্ছিন্ন ফুলিঙ্গে কেবল অহংকার বাড়ে, দৃষ্টি বাড়ে না। আমি অনেক দিন থেকেই লক্ষ্য করেছি, সন্দ্বীপের প্রকৃতির মধ্যে একটা লালসার স্থলত আছে। তার সেই মাংসবহুল আসক্তিই তাকে ধর্ম সম্বন্ধে মোহ রচনা করায়