পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৫১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ঘরে-বাইরে ૨.૭૮ চায় না । বলতে লাগল, মাস্টারবাবু, এগুলোকে দু-বেলা পেট ভরে খাওয়াব সে-শক্তিও নেই, আবার এদের ফেলে রেখে দৌড় মারব সে-মুক্তিও নেই, এমন করে বেঁধে মার কেন ? আমি কী পাপ করেছিলুম। এদিকে যে-ব্যবসাটুকু ধরে কোনোমতে তার দিন চলছিল তার স্বত্র ছিন্ন হয়ে গেছে। প্রথম দিনকতক ওই যে মাস্টারমশায়ের ওখানে সে বাসা পেলে, সেইটেকেই সে টেনে চলতে লাগল, তার নিজের বাড়িতে নড়বার নাম করতেও চায় না । শেষকালে মাস্টারমশায় তাকে বললেন, পঞ্চু, তুমি বাড়িতে যাও নইলে তোমার ঘরদুয়ারগুলো নষ্ট হয়ে যাবে। আমি তোমাকে কিছু টাকা ধার দিচ্ছি, তুমি কাপড়ের ব্যবসা করে অল্প অল্প করে শোধ দিয়ো । প্রথমট। পঞ্চুর মনে একটু খেদ হল—মনে করলে দয়াধৰ্ম বলে একটা জিনিস জগতে নেই। তার পরে টাকাটা নেবার বেলায় মাস্টারমশায় যখন হ্যাগুনোট লিখিয়ে নিলেন তখন ভাবলে, শোধ তো করতে হবে, এমন উপকারের মূল্য কী । মাস্টারমশায় কাউকে বাইরের দিকে দান করে ভিতরের দিকে ঋণী করতে নিতান্ত নারাজ —তিনি বলেন, মনের ইজ্জত চলে গেলে মানুষের জাত মারা হয়। হাগুনোটে টাকা নেওয়ার পর পঞ্চু মাস্টারমশায়কে খুব বড়ো করে প্রণাম করতে আর পারলে না, পায়ের ধুলোটা বাদ পড়ল। মাস্টারমশায় মনে মনে হাসলেন, তিনি প্রণামটা খাটো করতে পারলেই বাচেন । তিনি বলেন, আমি শ্রদ্ধা করব আমাকে শ্রদ্ধা করবে, মানুষের সঙ্গে এই সম্বন্ধই আমার খাটি, ভক্তি আমার পাওনার অতিরিক্ত । পঞ্চু কিছু ধুতি-শাড়ি কিছু শীতের কাপড় কিনে আনিয়ে চাষিদের ঘরে ঘরে বেচে বেড়াতে লাগল। নগদ দাম পেত না বটে, তেমনি কিছু বা ধান কিছু বা পাট কিছু বা অন্ত ফসল, যা হাতে হাতে আদায় করে আনত সেটা দামে কাটা যেত না । দু-মাসের মধ্যেই সে মাস্টারমশায়ের এক কিস্তি স্থদ এবং আপলের কিছু শোধ করে দিলে এবং এই ঋণশোধের অংশ প্ৰণামের থেকে কাটান পড়ল। পঞ্চু নিশ্চয় মনে করতে লাগল মাস্টারমশায়কে সে যে একদিন গুরু বলে ঠাউরেছিল, ভুল করেছিল, লোকটার কাঞ্চনের প্রতি দৃষ্টি আছে । এইরকমে পঞ্চুর দিন চলে যাচ্ছিল। এমন সময়ে স্বদেশীর বান খুব প্রবল হয়ে এসে পড়ল । আমাদের এবং আশপাশের গ্রাম থেকে যে-সব ছেলে কলকাতার স্থলে-কলেজে পড়ত তার ছুটির সময় ৰাড়ি ফিরে এল, তাদের অনেকে স্কুল-কলেজ ছেড়ে দিলে ; তারা সবাই সন্দীপকে দলপতি করে স্বদেশী প্রচারে মেতে উঠল। এদের অনেকেই আমার অবৈতনিক স্কুল থেকে এন্টেন্স পাশ করে গেছে, অনেককেই