পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৭৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ঘরে-বাইরে - २७> কোথা ? ইত্যাদি ইত্যাদি। রাধিকার গানের সঙ্গে তার একটি অক্ষরও মিলত না। তাই বলছি, মোহটাই হল সত্য, সেইটেই বঁশি,আর মোহ বাদ দিয়ে সেটা হচ্ছে ভাঙা বাশির ভিতরকার ফাক—সেই অত্যন্ত নির্মল শূন্ততাটা যে কী, তার আস্বাদ নিখিল আজকাল কিছু পেয়েছে, ওর মুখ দেখলেই সেটা বোঝা যায়। আমার মনেও কষ্ট লাগে। কিন্তু নিখিলের বড়াই, ও সত্যকে চায়, আমার বড়াই আমি মোহটাকে পারতপক্ষে হাত থেকে ফসকাতে দেব না। যাদৃশী ভাবনা যন্ত সিদ্ধিৰ্ভবতি তাদৃশী— অতএব এ নিয়ে দুঃখ করে কী হবে। বিমলার মনটাকে সেই উপরের হাওয়াতেই উড়িয়ে রাখবার জন্য পাচ হাজার টাকা সংক্ষেপে সেরে ফেলে, ফের আবার সেই মহিষমৰ্দিনীর পুজোর মন্ত্রণায় বসে গেলুম । পুজোট হবে কবে এবং কখন ? নিখিলের এলাকায় রুইমারিতে অস্ত্রানের শেষে যে হোসেনগাজির মেলা হয় সেখানে লক্ষ লক্ষ লোক আসে, সেইখানে পুজোটা যদি দেওয়া যায় তাহলে খুব জমাট হয়। বিমলা উৎসাহিত হয়ে উঠল । ও মনে করলে এ তো বিলিতি কাপড় পোড়ানো নয়, লোকের ঘর জালানো নয়, এতবড়ো সাধু প্রস্তাবে নিখিলের কোনে। আপত্তি হবে না। আমি মনে মনে হাসলুম,—ধারা ন-বছর দিনরাত্তির একসঙ্গে কাটিয়েছে, তারাও পরস্পরকে কত অল্প চেনে । কেবল ঘরকন্নার কথাটুকুতেই চেনে, ঘরের বাইরের কথা যখন হঠাৎ উঠে পড়ে তখন তারা আর থই পায় না। ওরা ন-বছর ধরে বসে বসে এই কথাটাই ক্রমাগত বিশ্বাস করে এসেছে যে, ঘরের সঙ্গে বাইরের অবিকল মিল বুঝি আছেই, আজ ওরা বুঝতে পারছে কোনোদিন যে-দুটোকে মিলিয়ে নেওয়া হয় নি আজ তারা হঠাৎ মিলে যাবে কী করে । যাক, যারা ভুল বুঝেছিল তারা ঠেকতে ঠেকতে ঠিক করে বুঝে নিক তা নিয়ে আমার বেশি চিস্তা করবার দরকার নেই। বিমলাকে তো এই উদ্দীপনার বেগে বেলুনের মতো অনেকক্ষণ উড়িয়ে রাখা সম্ভব নয়, অতএব এই হাতের কাজটা যত শীঘ্র পারা যায় সেরে নিতে হচ্ছে। বিমলা যখন চৌকি থেকে উঠে দরজা পর্যন্ত গেছে আমি নিতান্ত যেন উড়ো রকম ভাবে বললুম, রানী, তাহলে টাকাটা কবে— বিমলা ফিরে দাড়িয়ে বললে, এই মাসের শেষে মাসকাবারের সময়— আমি বললুম, না, দেরি হলে চলবে না। ’ তোমার কবে চাই ? কালই । আচ্ছা কালই এনে দেব।