পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩১৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

С) е е রবীন্দ্র-রচনাবলী একবার ভাবলুম, ফিরে যাই। কিন্তু পারলুম না। নিঃশব্দে বিমলার শিয়রের কাছে বসে তার মাথার উপর হাত রাখলুম। প্রথমটা তার সমস্ত শরীর কাঠের মতো শক্ত হয়ে উঠল—তার পরেই সেই কঠিনতা যেন ফেটে ভেঙে কাল্লা সহস্রধারায় বয়ে যেতে লাগল। মানুষের হৃদয়ের মধ্যে এত কান্না যে কোথায় ধরতে পারে সে তো ভেবে পাওয়া যায় না | আমি আস্তে আস্তে বিমলার মাথায় হাত বুলোতে লাগলুম। তার পরে কখন একসময়ে হাতড়ে হাতড়ে সে আমার পা-দুটো টেনে নিলে—বুকের উপরে এমনি করে চেপে ধরলে যে আমার মনে হল সেই আঘাতে তার বুক ফেটে যাবে। বিমলার অাত্মকথা আজ সকালে অমূল্যর কলকাতা থেকে ফেরবার কথা। বেহারাকে বলে রেখেছি সে এলেই যেন খবর দেয় । কিন্তু স্থির থাকতে পারছি নে । বাইরে বৈঠকখানায় গিয়ে বসে রইলুম। অমূল্যকে যখন আমার গয়না বেচবার জন্যে কলকাতায় পাঠালুম তখন নিজের কথা ছাড়া আর কোনো কথা বুঝি মনেই ছিল না। এ-কথা একবারও আমার বুদ্ধিতে এলই না যে, সে ছেলেমামুষ, অত টাকার গয়না কোথাও বেচতে গেলে সবাই তাকে সন্দেহ করবে। মেয়েমানুষ আমরা এত অসহায় যে আমাদের নিজের বিপদ অন্তের ঘাড়ে না চাপিয়ে আমাদের যেন উপায় নেই। আমরা মরবার সময় পাচ জনকে ডুবিয়ে মারি। বড়ো অহংকার করে বলেছিলুম, অমূল্যকে বাচাব। যে নিজে তলিয়ে যাচ্ছে সে নাকি অন্তকে বাচাতে পারে। হায়, হায়, আমিই বুঝি ওকে মারলুম। ভাই আমার, আমি তোর এমনি দিদি, যেদিন মনে মনে তোর কপালে ভাইফোট দিলুম সেইদিনই বুঝি যম মনে মনে হাসলে। আমি যে অকল্যাণের বোঝাই নিয়ে ফিরছি আজ। আমার আজ মনে হচ্ছে মানুষকে এক-এক সময়ে যেন অমঙ্গলের প্লেগে ধরে, হঠাৎ কোথা হতে তার বীজ এসে পড়ে আর এক রাত্রেই মৃত্যু ঘনিয়ে আসে। সেই সময়ে সকল সংসার থেকে খুব দূরে কোথাও তাকে সরিয়ে রাখা যায় না কি ? স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তার ছোয়াচ যে বড়ো ভয়ানক। সে যে বিপদের মশালের মতে, নিজে পুড়তে থাকে সংসারে আগুন লাগাবার জন্তেই ।