পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৩১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ঘরে-বাইরে 19ృa অন্ধকারে তার মুখের দিকে চাইলে সমস্ত নক্ষত্ৰলোকের গায়ে কাটা দিয়ে ওঠে। আমি যেখানে রয়েছি সেইখানেই নেই—যারা আমাকে ঘিরে রয়েছে আমি তাদের কাছে থেকেই দূরে। আমি চলছি ফিরছি বেঁচে আছি একটা বিশ্বব্যাপী বিচ্ছেদের উপরে –যেন পদ্মপাতার উপরকার শিশিরবিন্দুর মতো । কিন্তু মান্থব যখন বদলে যায় তখন তার আগাগোড়া সমস্ত বদল হয় না কেন ? হৃদয়ের দিকে তাকালে দেখতে পাই যা ছিল তা সবই আছে কেবল নড়ে-চড়ে গিয়েছে। যা সাজানো ছিল আজ তা এলোমেলে,—যা কণ্ঠের হারে গাথা ছিল আজ তা ধুলোয়। সেইজন্তেই তে। বুক ফেটে যাচ্ছে। ইচ্ছা করে মরি, কিন্তু সবই যে হৃদয়ের মধ্যে বেঁচে অাছে, মরার ভিতরে তো শেষ দেখতে পাচ্ছি নে। আমার মনে হচ্ছে যেন মরার মধ্যে আরও ভয়ানক কান্না । যা-কিছু চুকিয়ে দেবার তা বাচার ভিতর দিয়েই চুকোতে পারি—অন্ত উপায় নেই। এবারকার মতো একবার আমাকে মাপ করে, হে আমার প্রভু। যা-কিছুকে তুমি আমার জীবনের ধন বলে আমার হাতে তুলে দিয়েছিলে সে-সমস্তকেই আমি আমার জীবনের বোঝা করে তুলেছি। আজ তা আর বহনও করতে পারছি নে ত্যাগ করতেও পারছি নে। আর-একদিন তুমি আমার ভোরবেলাকার রাঙা আকাশের ধারে দাড়িয়ে যে-বাশি বাজিয়েছিলে সেই বাশিটি বাজাও, সব সমস্ত সহজ হয়ে যাক—তোমার সেই বঁশির স্বরটি ছাড়া ভাঙাকে কেউ জুড়তে পারে না, অপবিত্রকে কেউ শুভ্র করতে পারে না। সেই বাশির মুরে আমার সংসারকে তুমি নতুন করে স্বষ্টি করো। নইলে আমি আর কোনো উপায় দেখি নে । মাটির উপর উপুড় হয়ে পড়ে কাদতে লাগলুম—একটা কোনো-দয়া কোথাও থেকে চাই, একটা কোনো-আশ্রয়, একটু ক্ষমার আভাস, একটা এমন আশ্বাস যে, সব চুকে যেতেও পারে। মনে মনে বললুম, আমি দিনরাত ধরনা দিয়ে পড়ে থাকব প্রভূ— আমি খাব না, আমি জলস্পর্শ করব না, যতক্ষণ না তোমার আশীৰ্বাদ এসে পৌছয়। l এমন সময় পায়ের শব্দ শুনলুম। আমার বুকের ভিতরটা দুলে উঠল। কে বলে দেবতা দেখা দেন না। আমি মুখ তুলে চাইলুম না পাছে আমার দৃষ্টি তিনি সইতে না পারেন।. এস, এস, এস—তোমার পা আমার মাথায় এসে ঠেকুক, আমার এই বুকের কাপনের উপরে এসে দাড়াও, প্রভু, আমি এই মুহূর্তেই মরি। আমার শিয়রের কাছে এসে বসলেন। কে ? আমার স্বামী ! আমার স্বামীর হৃদয়ের মধ্যে আমার সেই দেবতারই সিংহাসন নড়ে উঠেছে যিনি আমার কান্না আর