পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪১০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৩৯৬ রবীন্দ্র-রচনাবলী অতএব মানুষ আপনার আনন্দপ্রকাশের দ্বারা সাহিত্যে কেবল আপনারই নিত্যরূপ শ্রেষ্ঠরূপ প্রকাশ করিতেছে। আমি জানি, সাহিত্য হইতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রমাণ আহরণ করিয়া আমার মোটকথাটাকে খণ্ডখণ্ড করিয়া ফেলা অত্যন্ত সহজ। সাহিত্যের মধ্যে যেখানে যাহা-কিছু স্থান পাইয়াছে, তাহার সমস্তটার জবাবদিহি করিবার দায় যদি আমার উপরে চাপানো হয়, তবে সে আমার বড়ো কম বিপদ নয়। কিন্তু মানুষের সমস্ত বৃহৎ ব্যাপারের মধ্যে শত শত আত্মবিরোধ থাকে। যখন বলি, জাপানির নিভীক সাহসে লড়াই করিয়াছিল, তখন জাপানি সেনাদলের প্রত্যেক লোকটির সাহসের হিসাব লইতে গেলে নানা স্থানেই ক্রটি দেখা যাইবে—কিন্তু ইহা সত্য, সেই সমস্ত ব্যক্তিবিশেষের ভয়কেও সম্পূর্ণ আত্মসাৎ করিয়া জাপানিদের সাহস যুদ্ধে জয়ী হইয়াছে। সাহিত্যে মানুষ বৃহৎভাবে আত্মপ্রকাশ করিতেছে, সে ক্রমশই তাহার আনন্দকে খণ্ড হইতে অখণ্ডের দিকে অগ্রসর করিয়া ব্যক্ত করিতেছে—বড়ো করিয়া দেখিলে এ-কথা সত্য— বিকৃতি এবং ক্রটি যতই থাক, তবু সব লইয়াই এ-কথা সত্য। একটি কথা আমাদিগের মনে রাখিতে হইবে,—সাহিত্য দুই রকম করিয়া আমাদিগকে আনন্দ দেয়। এক, সে সত্যকে মনোহররূপে আমাদিগকে দেখায়, আর, সে সত্যকে আমাদের গোচর করিয়া দেয় । সত্যকে গোচর করানো বড়ো শক্ত কাজ। হিমালয়ের শিখর কত-হাজার ফিট উচু, তাহার মাথায় কতখানি বরফ আছে, তাহার কোন অংশে কোন শ্রেণীর উদ্ভিদ জন্মে, তাহা তন্নতন্ন করিয়া বলিলেও হিমালয় আমাদের গোচর হয় না। যিনি কয়েকটি কথায় এই হিমালয়কে আমাদের গোচর করিয়া দিতে পারেন, তাহাকে আমরা কবি বলি। হিমালয় কেন, একটা পানাপুকুরকেও আমাদের মনশ্চক্ষুর সামনে ধরিয়া দিলে আমাদের আনন্দ হয়। পানাপুকুরকে চোখে আমরা অনেক দেখিয়াছি, কিন্তু তাহাকেই ভাষার ভিতর দিয়া দেখিলে তাহাকে নূতন করিয়া দেখা হয় —মন চক্ষুরিস্ক্রিয় দিয়া যেটাকে দেখিতে পায়, ভাষা যদি ইন্দ্রিয়স্বরূপ হইয়া সেইটেকেই দেখাইতে পারে, তবে মন তাহাতে নূতন একটা রস লাভ করে। এইরূপে সাহিত্য আমাদের নূতন একটি ইঞ্জিয়ের মতো হইয়া জগৎকে আমাদের কাছে নূতন করিয়া দেখায়। কেবল নূতন নয় – ভাষার একটা বিশেষত্ব আছে, সে মামুষের নিজের জিনিস–সে অনেকট। আমাদের মনগড়া ; এই জন্ত বাহিরে যে-কোনো জিনিসকে সে আমাদের কাছে আনিয়া দেয়, সেটাকে যেন বিশেষ করিয়া মানুষের জিনিস করিয়া তোলে। ভাষা যে-ছবি অঁাকে, সে-ছবি যে যথাযথ ছবি বলিয়া আমাদের কাছে আদর পায়, তাহ। নহে—ভাষা যেন