পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৮৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

84 e রবীন্দ্র-রচনাবলী এবং স্বাক্ষ বিচারশক্তিবলে কেবল রক্ষুকো প্রভৃতির ন্যায় মানবচরিত্র ও লোকসংখ্যার সম্বন্ধে পাক প্রবন্ধ লিখতে পারা যায়—কিন্তু শেকম্পীয়র তার নাটকের পাত্রগণকে নিজের জীবনের মধ্যে সঞ্জীবিত করে তুলেছিলেন, অস্তরের নাড়ির মধ্যে প্রবাহিত প্রতিভার মাতৃরস পান করিয়েছিলেন, তবেই তারা মানুষ হয়ে উঠেছিল, নইলে তারা কেবলমাত্র প্রবন্ধ হত । অতএব এক হিসেবে শেকস্পীয়রের রচনাও আত্মপ্রকাশ কিন্তু খুব সম্মিশ্ৰিত, বৃহৎ এবং বিচিত্র। সাহিত্যের প্রধান লক্ষণ হচ্ছে মানবজীবনের সম্পর্ক । মামুষের মানসিক জীবনটা কোনখানে ? যেখানে আমাদের বুদ্ধি এবং হৃদয়, বাসন এবং অভিজ্ঞতা সবগুলি গলে গিয়ে মিশে গিয়ে একটি সম্পূর্ণ ঐক্যলাভ করেছে। যেখানে আমাদের বুদ্ধি প্রবৃত্তি এবং রুচি সম্মিলিতভাবে কাজ করে। এক-কথায়, যেখানে আদিত মানুষটি আছে। সেইখানেই সাহিত্যের জন্মলাভ হয় । মানুষ ভিন্ন ভিন্ন অবস্থায় খও খও ভাবে প্রকাশ পায় । সেই খণ্ড অংশগুলি বিজ্ঞান দর্শন প্রভৃতি রচনা করে। পর্যবেক্ষণকারী মানুষ বিজ্ঞান রচনা করে, চিস্তাশীল মানুষ দর্শন রচনা করে, এবং সমগ্র মাহুষটি সাহিত্য রচনা করে । গেটে উদ্ভিদতত্ত্ব সম্বন্ধে বই লিখেছেন । তাতে উদ্ভিদরহস্ত প্রকাশ পেয়েছে, কিন্তু গেটের কিছুই প্রকাশ পায় নি, অথবা সামান্ত এক অংশ প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু গেটে যে-সমস্ত সাহিত্য রচনা করেছেন, তার মধ্যে মূল মানবটি প্রকাশ পেয়েছেন। বৈজ্ঞানিক গেটের অংশও অলক্ষিত মিশ্রিত ভাবে তার মধ্যে আছে। যিনি যাই বলুন শেকস্পয়রের কাব্যের কেন্দ্রস্থলেও একটি অমৃত ভাবশরীর শেকম্পয়রকে পাওয়া যায়, যেখান থেকে তার জীবনের সমস্ত দর্শন বিজ্ঞান ইতিহাস বিরাগ অনুরাগ বিশ্বাস অভিজ্ঞতা সহজ জ্যোতির মতো চতুর্দিকে বিচিত্র শিখায় বিবিধ বর্ণে বিচ্ছুরিত হয়ে পড়ছে ; যেখান থেকে ইয়াগোর প্রতি বিদ্বেষ, ওথেলোর প্রতি অনুকম্পা, ডেসডিমোনার প্রতি প্রতি, ফলস্টাফের প্রতি সকৌতুক সখ্য, লিয়ারের প্রতি সসন্ত্রম করুণ, কর্ডেলিয়ার প্রতি সুগভীর স্নেহ শেকস্পীয়রের মানব-হৃদয়কে চিরদিনের জন্য ব্যক্ত ও বিকীর্ণ করছে । সাহিত্যের সত্য কাকে বলা যেতে পারে এইবার সেটা বলবার অবসর হয়েছে। লেখাপড়া দেখাশোনা কথাবার্তা ভাবাচিত্তা সবযুদ্ধ জড়িয়ে আমরা প্রত্যেকেই আমাদের সমগ্র জীবন দিয়ে নিজের সম্বন্ধে, পরের সম্বন্ধে, জগতের সম্বন্ধে একটা মোট সত্য পাই। সেইটেই আমাদের জীবনের মূল সুর। সমস্ত জগতের বিচিত্র স্বরকে আমরা সেই মুরের সঙ্গে মিলিয়ে নিই, এবং আমাদের সমস্ত জীবন-সংগীতকে