পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫১৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ઉ ૭૨ রবীন্দ্র-রচনাবলী তাহার বসনভূষণ গড়িতে পারি, তেমনি সাহিত্যের গঠনকার্ষে পরামর্শপূর্বক হস্তক্ষেপ করা যায় না বটে, কিন্তু তাহার আয়োজনকার্য একেবারে আমাদের আয়ত্তাতীত নহে । ব্যাকরণ, অভিধান, ভাষাতত্ত্ব প্রভৃতি সংগ্রহ করা দলবদ্ধ চেষ্টার দ্বারা সাধ্য। চেষ্টার স্বত্রপাত পূর্ব হইতেই হইয়াছে ; অমুকুল সময় উপস্থিত হইলেই এই উদযোগের গৌরব একদিন সকলের নিকট সুস্পষ্ট হইয়া উঠিবে এবং বঙ্গীয়সাহিত্য-পরিষৎ যে স্বদেশের কত অন্তরঙ্গ ও অন্যান্য বহুতর লোকখ্যাত মুখর অনুষ্ঠানের অপেক্ষ যে কত মহৎ এবং সত্য, একদিন তাহ নিঃসংশয়ে সপ্রমাণ হইবে। আমাদের দেশের পুরাবৃত্ত, ভাষাতত্ত্ব, লোকবিবরণ প্রভৃতি সমস্তই এ-পর্যন্ত বিদেশী পণ্ডিতেরা সংগ্রহ এবং আলোচনা করিয়া আসিয়াছেন । বিদেশী বলিয়া তাহাদের চেষ্টা অসম্পূর্ণ এবং ভ্রমসংকুল হইতে পারে, এই কারণেই যে আমি আক্ষেপ করিতেছি, তাহা নহে। দেশে থাকিয়া দেশের বিবরণ সংগ্ৰহ করিতে আমরা একেবারে উদাসীন, এমন লজ্জা আর নাই । ইহা আমাদের পক্ষে কতবড়ো একটা গালি, তাহা আমরা অনুভব করি না । বেদনাসম্বন্ধে সংজ্ঞা না থাকা যেমন রোগের চরম অবস্থা, তেমনি যখন হীনতার লক্ষণগুলিসম্বন্ধে আমাদের চেতনাই থাকে না, তখনই বুঝিতে হইবে, দুৰ্গতিপ্রাপ্ত জাতির এই লজ্জাহীনতাই চরম লজ্জার বিষয় । আমাদের দেশে এই একান্ত অসারতার ছোটোবড়ো প্রমাণ সর্বদাই দেখিতে পাই । বাঙালি হইয়া বাঙালিকে, পিতাভাত-আত্মীয়স্বজনকে ইংরেজিতে পত্র লেখা যে কতবড়ো লাঞ্ছনা, তাহা আমরা অকুভবমাত্র করি না ;– আমরা যখন অসংযত করতালিম্বারা স্বদেশী বক্তাকে এবং হিপ হিপ হররে ধ্বনিতে স্বদেশী মান্তব্যক্তিকে উৎসাহ জানাইয়া থাকি, তখন সেই কৰ্ণকটু বিজাতীয় বর্বরতায় আমরা কেহ সংকোচমাত্র বোধ করি না ;—যে-সকল অশ্রদ্ধাপরায়ণ পরদেশীর কোনোপ্রকার আমোদ-আহলাদে সমাজরুত্যে আমাদের কোনোদিন কোনো অাদর কোনো আহান নাই, তাহাদিগকে আমাদের দেবপূজায় ও বিবাহাদি শুভকর্মে গড়ের বাস্ত সহকারে প্রচুর মদ্যমাংস সেবন করানোকে উৎসবের অঙ্গ বলিয়া আমরা গণ্য করি, ইহার বীভৎসতা আমাদের হৃদয়ের কোথাও বাজে না । তেমনি আমরা আজ অন্তত বিশ-পচিশ বৎসর পরের সিংহদ্বারে মুষ্টিভিক্ষার জন্য প্রতিদিন নিষ্কলযাত্রা করিয়া নিজেকে দেশহিতৈষী বলিয়া নিঃসংশয়ে স্থির করিয়াছি, অথচ দেশের দিকে একবার ফিরিয়াও তাকাই না, ইহাও একটা অজ্ঞানকৃত প্রহসন। দেশের বিবরণ জানিতে, তাহার ভাষা, ভূগোল, ইতিবৃত্ত, জীবজন্তু, উদ্ভিদ, মন্থন্ত, তাহার কথা কাহিনী,