পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৫৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ ¢xDዓ নিতান্ত হৃদয়হীনতার কাজ । যাহা হউক, সকলের নিকট হইতে তাড়না খাইয়া সংশয়ীর দল থামিয়া গেল । ফকিরের অতিভীষণ আটল গাভীর্যের প্রতি ভুক্ষেপমাত্র না করিয়া পাড়ার লোকেরা তাহাকে ঘিরিয়া বসিয়া বলিতে লাগিল, “আরে আরে, আমাদের সেই মাখন আজ ঋষি হয়েছেন, তপস্বী হয়েছেন, চিরটা কাল ইয়ার্কি দিয়ে কাটালে, আজ হঠাৎ মহামুনি জামদগ্নি হয়ে বসেছেন।” কথাটা উন্নতচেতা ফকিরের অত্যন্ত খারাপ লাগিল, নিরুপায়ে সহ্য করিতে হইল। একজন গায়ের উপর আসিয়া পড়িয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘ওরে মাখন, তুই কুচুকুচে কালো ছিলি, রঙটা এমন ফর্সা করলি কী করে ? ফকির উত্তর দিল, “যোগ অভ্যাস করে ।” সকলেই বলিল, “যোগের কী আশ্চর্য প্রভাব ।” একজন উত্তর করিল, “আশ্চর্য আর কী । শাস্ত্ৰে আছে, ভীম যখন হনুমানের লেজ ধরে তুলতে গেলেন, কিছুতেই তুলতে পারলেন না । সে কী করে হল । সে তো যোগ-বলে |’ এ কথা সকলকেই স্বীকার করিতে হইল । হেনকালে ষষ্ঠীচরণ আসিয়া ফকিরকে বলিল, “বাবা, একবার বাড়ির ভিতরে যেতে হচ্ছে।” এ সম্ভাবনাটা ফকিরের মাথায় উদয় হয় নাই- হঠাৎ বজ্ৰাঘাতের মতো মস্তিষ্কে প্রবেশ করিল। অনেকক্ষণ চুপ করিয়া, পাড়ার লোকের বিস্তর অন্যায় পরিহাস পরিপাক করিয়া অবশেষে বলিল, “বাবা, আমি সন্ন্যাসী হয়েছি, আমি অন্তঃপুরে ঢুকতে পারব না।” ষষ্ঠীচরণ পাড়ার লোকদের সম্বোধন করিয়া বলিল, “তা হলে আপনাদের একবার গা তুলতে হচ্ছে। বউমাদের এইখানেই নিয়ে আসি। তঁরা বড়ো ব্যাকুল হয়ে আছেন।” সকলে উঠিয়া গেল । ফকির ভাবিল, এইবেলা এখান হইতে এক দৌড় মারি । কিন্তু, রাস্তায় বাহির হইলেই পাড়ার লোক কুকুরের মতো তাহার পশ্চাতে ছুটিবে ইহাই কল্পনা করিয়া তাহাকে নিস্তব্ধভাবে বসিয়া থাকিতে হইল । ” যেমনি মাখনলালের দুই স্ত্রী প্রবেশ করিল ফকির অমনি নতশিরে তাহাদিগকে প্ৰণাম করিয়া কহিল, “মা, আমি তোমাদের সন্তান ।” অমনি ফকিরের নাকের সম্মুখে একটা বালা-পরা হাত খড়গের মতো খেলিয়া গেল এবং একটি কাংস্যবিনিন্দিত কণ্ঠে বাজিয়া উঠিল, ‘ওরে ও পোড়াকপালে মিনসে, তুই মা বললি কাকে ৷” অমনি আর-একটি কণ্ঠ আরো দুই সুর উচ্চে পাড়া কঁপাইয়া ঝংকার দিয়া উঠিল, “চোখের মাথা খেয়ে বসেছিস ! তোর মরণ হয় না। ’ নিজের স্ত্রীর নিকট হইতে এরূপ চলিত বাংলা শোনা অভ্যাস ছিল না, সুতরাং একান্ত কাতর হইয়া ফকির জোড়হন্তে কহিল, “আপনারা ভুল বুঝছেন। আমি এই আলোতে দাঁড়াচ্ছি, আমাকে একটু ঠাউরে দেখুন !” প্ৰথমা ও দ্বিতীয়া পরে পরে কহিল, ‘ঢের দেখেছি। দেখে দেখে চোখ ক্ষয়ে গেছে। তুমি কচি খোকা নও, আজ নতুন জন্মাও নি । তোমার দুধের দাত অনেকদিন ভেঙেছে। তোমার কি বয়সের গাছ-পাথর আছে । তোমায় যম ভুলেছে বলে কি আমরা ভুলব ।” এরূপ এক-তরফা দাম্পত্য আলাপ কতক্ষণ চলিত বলা যায় না- কারণ, ফকির একেবারে বাকশক্তিরহিত হইয়া নতশিরে দাড়াইয়া ছিল। এমন সময় অত্যন্ত কোলাহল শুনিয়া এবং পথে লোক জমিতে দেখিয়া ষষ্ঠীচরণ প্রবেশ করিল। বলিল, “এতদিন আমার ঘর নিস্তব্ধ ছিল, একেবারে টু শব্দ ছিল মা। আজ মনে হচ্ছে, বটে, আমার মাখন ফিরে এসেছে।’ ফকির করজোড়ে কহিল, মশায়, আপনার পুত্রবধুদের হাত থেকে আমাকে রক্ষে করুন।” । ষষ্ঠী । বাবা, অনেকদিন পরে এসেছি, তাই প্রথমটা একটু অসহ্য বোধ হচ্ছে । তা, মা তোমরা এখন যাও । বাবা মাখন তো এখন এখানেই রইলেন, ওঁকে আর কিছুতেই যেতে দিচ্ছি নে । ললনাৰ্দ্ধয় বিদায় হইলে ফকির ষষ্ঠীচরণকে বলিল, “মশায়, আপনার পুত্র কেন যে সংসার ত্যাগ করে গেছেন তা আমি সম্পূর্ণ অনুভব করতে. পারছি। মশায়, আমার প্রণাম জানবেন, আমি চললেম ।’ বৃদ্ধ এমনি উচ্চৈঃস্বরে ক্ৰন্দন উত্থাপন করিল যে, পাড়ার লোক মনে করিল মাখন তাহার ব্যাপকে