পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬১২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Gabo রবীন্দ্র-রচনাবলী জীবনযাত্রার পক্ষে আবশ্যক নয়, তাকেও, কেবলই সে তৈরি করে তুলছে । কেননা, সে মুক্তি চায় । সে আপনার অন্তরাচ্ছাদন থেকে মুক্তি চায়, সে আপনার অরূপের আবরণ থেকে মুক্তি চায় । সে আপনাকে দেখতে চায়, পেতে চায়। ঝোপঝাড় কেটে সে যখন বাগান তৈরি করে তখন কুরূপতার মধ্য থেকে সে যে সৌন্দর্যকে মুক্ত করে তোলে সে তার নিজেরই ভিতরকার সৌন্দৰ্য- বাইরে তাকে মুক্তি দিতে না পারলে অন্তরেও সে মুক্তি পায় না । সমাজের যথেচ্ছাচারের মধ্যে সুনিয়ম স্থাপন করে। অকল্যাণের বাধার ভিতর থেকে যে কল্যাণকে সে মুক্তি দান করে সে তারই নিজের ভিতরকার কল্যাণ-বাইরে তাকে মুক্তি দিতে না পারলে অন্তরেও সে মুক্তিলাভ করে না। এমনি করে মানুষ নিজের শক্তিকে, সৌন্দর্যকে, মঙ্গলকে, নিজের আত্মাকে, নানাবিধ কর্মের ভিতরে কেবলই বন্ধনমুক্ত করে দিচ্ছে । যতই তাই করছে ততই আপনাকে মহৎ করে দেখতে পাচ্ছে ; ততই তার আত্মপরিচয় বিস্তীর্ণ হয়ে যাচ্ছে । উপনিষৎ বলেছেন ; কুর্বন্নেবেহ কর্মণি জিজীবিষেৎ শতং সমাঃ । কর্মকরতে করতেই শত বৎসর বেঁচে থাকতে ইচ্ছা করবে। যারা আত্মার আনন্দকে প্রচুর রূপে উপলব্ধি করেছেন এ হচ্ছে তাদেরই বাণী । র্যারা আত্মাকে পরিপূর্ণ করে জেনেছেন তারা কোনোদিন দুর্বল মুহ্যমানভাবে বলেন না— জীবন দুঃখময় এবং কর্ম কেবলই বন্ধন। দুর্বল ফুল যেমন বেঁটাকে আলগা করে ধরে এবং ফল ফলবার পূর্বেই খসে যায়। তারা তেমন নন । জীবনকে তারা শক্ত করে ধরেন এবং বলেন, আমি ফল না। ফলিয়ে কিছুতেই ছাড়ছি নে । তারা সংসারের মধ্যে কর্মের মধ্যে আনন্দে আপনাকে প্রবলভাবে প্রকাশ করবার জন্যে ইচ্ছা করেন । দুঃখ তাপ তাদের অবসন্ন করে না, নিজের হৃদয়ের ভারে তারা ধূলিশায়ী হয়ে পড়েন না । সুখ দুঃখ সমস্তের মধ্য দিয়েই তারা আত্মার মাহাত্ম্যকে উত্তরোত্তর উদঘাটিত করে আপনাকে দেখেন এবং আপনাকে দেখিয়ে বিজয়ী বীরের মতো সংসারের ভিতর দিয়ে মাথা তুলে চলে যান। বিশ্বজগতে যে শক্তির আনন্দ নিরন্তর ভাঙাগড়ার মধ্যে লীলা করছে- তারই নৃত্যের ছন্দ তাদের জীবনের লীলার সঙ্গে তালে তালে মিলে যেতে থাকে ; তাদের জীবনের আনন্দের সঙ্গে সূর্যালোকের আনন্দ, মুক্ত সমীরণের আনন্দ, সুর মিলিয়ে দিয়ে অন্তর-বাহিরকে সুধাময় করে তোলে। তারাই বলেন : কুৰ্বন্নেবেহ কর্মণি জিজীবিষেৎ শতং সমাঃ । কাজ করতে করতেই শত বৎসর বেঁচে থাকতে ইচ্ছা করবে । মানুষের মধ্যে এই-যে জীবনের আনন্দ, এই—যে কর্মের আনন্দ আছে, এ অত্যন্ত সত্য। এ কথা বলতে পারব না। এ আমাদের মোহ, এ কথা বলতে পারব না যে একে ত্যাগ না করলে আমরা ধর্মসাধনার পথে প্ৰবেশ করতে পারব না। ধর্মসাধনার সঙ্গে মানুষের কর্মজগতের বিচ্ছেদ ঘটানো কখনোই মঙ্গল নয় । বিশ্বমানবের নিরন্তর কর্মচেষ্টাকে তার ইতিহাসের বিরাট ক্ষেত্রে একবার সত্যদৃষ্টিতে দেখো। যদি তা দেখ তা হলে কর্মকে কি কেবল দুঃখের রূপেই দেখা সম্ভব হবে। তা হলে আমরা দেখতে পাব কর্মের দুঃখকে মানুষ বহন করছে। এ কথা তেমন সত্য নয়। যেমন সত্য কর্মই মানুষের বহু দুঃখ বহন করছে, বহু ভার লাঘব করছে। কর্মের স্রোত প্রতিদিন আমাদের অনেক বিপদ ঠেলে ফেলছে, অনেক বিকৃতি ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এ কথা সত্য নয় যে মানুষ দায়ে পড়ে কর্মকরছে- তার এক দিকে দায় আছে, আর-এক দিকে সুখও আছে ; কর্ম এক দিকে অভাবের তাড়নায়, আর-এক দিকে স্বভাবের পরিতৃপ্তিতে । এইজন্যেই মানুষ যতই সভ্যতার বিকাশ করছে ততই আপনার নূতন নূতন দায় কেবল বাড়িয়েই চলেছে, ততই নূতন নূতন কর্মকে সে ইচ্ছা করেই সৃষ্টি করছে। প্রকৃতি জোর করে আমাদের কতকগুলো কাজ করিয়ে সচেতন করে রেখেছে, নানা ক্ষুধাতৃষ্ণার তাড়নায় আমাদের যথেষ্ট খাটিয়ে মারছে। কিন্তু, আমাদের মনুষ্যত্বের তাতেও কুলিয়ে উঠল না। পশুপক্ষীর সঙ্গে সমান হয়ে প্রকৃতির ক্ষেত্রে তাকে যে কাজ করতে হচ্ছে তাতেই সে চুপ করে থাকতে পারলে না ; কাজের ভিতর দিয়ে ইচ্ছা করেই সে সবাইকে ছাড়িয়ে যেতে চায় । মানুষের মতো কাজ কোনো জীবকে করতে হয় না। আপনার সমাজের একটি অতি বৃহৎ কাজের ক্ষেত্র তাকে নিজে তৈরি করতে হয়েছে। এখানে কত কাল থেকে সে কত ভাঙছে গড়ছে, কত নিয়ম বঁধছে কত নিয়ম ছিন্ন করে দিচ্ছে, কত পাথর কাটছে কত পাথর গাথছে, কত ভাবছে কত খুঁজছে কত কঁাদছে। এ ক্ষেত্রেই তার সকলের চেয়ে বড়ো বড়ো লড়াই লড়া হয়ে গেছে। এইখানেই সে নব নব জীবন লাভ করেছে। এইখানেই তার মৃত্যু পরম গীেরবময় । এইখানে সে দুঃখকে এড়াতে চায় নি, নূতন নূতন দুঃখকে স্বীকার করেছে।