পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১৭৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

প্ৰবন্ধ S (፩ (፩ করিয়াছিল যে সাফল্য, তাহার কোনাে চিহ্নই সে পটভূমিতে দেখি না। বাস্তবিক, আমার কতকগুলি পুরানো চিঠি আজ পড়িলে আমার নিজের প্রতি করুণা হয়, আমার হাসি পায়। আমার প্রতি বিশ্বাস রাখার মূর্খতা যাহাদের ছিল সেই বন্ধুদের উৎসাহ জিয়াইয়া রাখিবার মতো পুঁজি আমার খুব কম ছিল; তবু সেই সময় তাহার অর্থ ভাণ্ডারের ঘাটতি পূরণ করিবার সম্ভাবনার কথা জানাইয়া তাহাকে উৎসাহ দিবার চেষ্টা করিয়াছি। পরে তিনি নিজের আশ্চর্য ব্যক্তিত্ব দ্বারা এবং তাহার প্রতিভার প্রতি জনসাধারণের বিশ্বাস জাগ্ৰত করিয়া শ্ৰদ্ধার অজস্র দানলাভ করেন; তঁহার পাশে আমার অনিয়মিত সাহায্য তুচ্ছ ও হাস্যকরা; আমার সেই-সব প্রতিশ্রুতির গর্বিত গাম্ভীর্যের কথা ভাবিলে হাসিও পায়, ভালোও লাগে। কিন্তু আমি আবার বলি, অবাস্তব স্বপ্ন দেখায় মাধুর্য ছিল; মাধুর্য ছিল যথাসাধ্য সাহায্য দান, যতই সে সামান্য হােক। কারণ মহত্ত্বের প্রতি বিশ্বাসে যে আনন্দ ও যে সাহস আছে তাহার প্রমাণ উহাতে পাই আর মহত্ত্বে বিশ্বাসই তো মনের মহাৰ্য সম্পদ। বিজ্ঞানীর আত্মোপলব্ধির উজ্জ্বল মুহুর্তে খেয়ালি কবি তীহার যোগ্য সঙ্গী নয়, তা ছাড়া আমার শিক্ষাতেও ছিল ত্রুটি তথাপি আমি তাঁহার অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গৃহীত হই এবং সম্ভবত আমাদের স্বভাবগত বৃত্তির বৈপরীত্যের জন্যই আমি তাহার সিদ্ধির আকাঙ্ক্ষাকে কিছু উদ্দীপিত করিতে পারি। আমার মানসিক গঠনে আবশ্যক পরিমাণ দম্ভ নাই বলিয়া এ ব্যাপারটি আমার মনে চিরকালের বিস্ময় হইয়া আছে। তার পর আমাদের সময় কাটিয়াছে দ্রুত, আমাদের আশা পূর্ণতা লাভ করিয়াছে। তাহার দ্রুতবর্ধমান সাফল্যের কালে তাহার লক্ষ্যপথে আমার সঙ্গদানের প্রেরণা আমি ক্রমশ কম বোধ করিয়াছি। তঁহার পথ তখন আর দুৰ্গম বা অনিশ্চয় ছিল না। তঁহার কর্মজীবনের মেঘাবৃত প্রভাতে ভাগ্যের দ্বিধাবিজড়িত বেদনাকর মুহূর্তে আমার অবিচলিত বিশ্বাস দ্বারা তাহার সন্ধিক্ষণে সেইরূপ সামান্য সংগতির লোকও খুব বেশি কাজে আসে। জয়ের উপর যথার্থ শক্তির দাবি অপ্রতিযোগ্য। তাহার ভ্রমণপথে সমস্ত সমধর্মী উপাদানকে আকর্ষণ করিয়া সে কাজে লাগায় এবং জয়শ্ৰীর প্রতিমূর্তি গড়িয়া তোলে। এই বিজ্ঞান মন্দির সেইরূপ একটি প্রতিমূর্তি, ইহার মধ্যে আচার্যের জীবনব্যাপী উদ্যম, অনুরূপ উদ্যমের প্রেরণা কেন্দ্ররূপে স্থায়ী মূর্তি গ্রহণ করিয়াছে। ভাগ্যের প্রতি আচার্যের প্রতিভা প্রথম যে দ্বন্দ্বের আহবান জানায়, তাহার সহিত আমার সংযোগ দূর ইতিহাসের কথা; আমার নিজের কাছেই সে পৃষ্ঠা অস্পষ্ট হইয়া আসিয়াছে। এই কারণে এই প্রতিষ্ঠানের আনুষ্ঠানিক সভায় সম্মান-আসনে উপবেশনের আমন্ত্রণ গ্রহণে আমি রীতিমতো ইতস্তত করিয়াছিলাম। যৌবনের প্রগলভতর মূঢ় গর্বে আমি কল্পনা করিয়াছিলাম যে, আমার সম্মুখে যে ইতিহাস রূপ গ্রহণ করিতেছে, আমার সাহচৰ্যও তাহার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গরূপে গড়িয়া উঠিতেছে। সেই বিশ্বাসে আমি আচাৰ্যকে উৎসাহদানের চেষ্টা করি; সে চেষ্টা ছিল আমার অহমিকারই অঙ্গ। কিন্তু মূঢ় যৌবন চিরজীবী নয়; আমার ক্ষমতার সীমা উপলব্ধি করিবার সময় আমি পাই। এ কথা সকলেরই জানা, আমি নেহাত একজন কবি; ভাষা মন্দিরে আমার সাধনা, এ দেবতা সবচেয়ে খেয়ালি, যুক্তির নিকট র্তাহার দায়িত্ব তিনি প্রায়ই ভুলিয়া যান এবং প্রায়ই কল্পনার ছায়াচ্ছন্ন জগতে নিজেকে হারাইয়া ফেলেন। পবিত্র পীঠস্থানে যোগ্য অৰ্ঘদান আমাদের প্রাচ্য রীতি; কিন্তু বিদ্বান সমাজের এই স্মরণীয় সম্মেলনে আমার ভাষার অর্ঘ্য নিতান্ত অনুপযুক্ত। সৌভাগ্যক্রমে আমাদের মধ্যে আজ এমন কয়েকজন আছেন, যাঁহারা বিজ্ঞানের রাজ্যে অভিজাত শ্রেণীর সহিত সমান আসনের অধিকারী এবং যাঁহাদের চিন্তাসম্ভার এই অনুষ্ঠানকে সমৃদ্ধ করিবে বলিয়া আশী করাখায়। ভূমি শুধু এই প্রতিষ্ঠানকে আশীর্বাদ করিতে পারি দূর