পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৬৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

S ( Ο রবীন্দ্র-রচনাবলী পৃথ্বশ বললে, “সে কথা মাথা হােঁট করে মানব, পুরুষ জাত দুর্বল জাত।” বাঁশরি বললে, “তোমরা আবার রিয়ালিস্ট। রিয়ালিস্ট মেয়েরা। আমরা মস্তর মানি নে। যতবড়ো স্কুল পদার্থ হও, তােমরা যা, তোমাদের তাই বলেই জানি। রঙ আমরা মাখাই নে তোমাদের মুখে, মাখি নিজে। রূপকথার খোকা সব, মেয়েদের কাজ হয়েছে তোমাদের ভোলানো। পোড়া কপাল আমাদের! এখীনা, মিনার্ভা! হায় রে হায়! ওগো রিয়ালিস্ট, এটুকু বুঝতে পার না যে, রাস্তায় চলতে চলতে যাদের দেখেছি পানওয়ালির দোকানে একেছ কড়া তুলিতে যাদের মূর্তি, তারাই সেজে বেড়াচ্ছে এখীনা, মিনার্ভা।” বাঁশরির ঝােঝ দেখে পৃথীশ মনে মনে হাসলে। বললে, “বৈদিক কালে ঋষিদের কাজ ছিল মস্তর পড়ে দেবতা ভোলোনো - কিন্তু যাদের ভোলাতেন তাদের ভক্তি করতেন। তোমাদের যে সেই দশা দেখি বাঁশি। বোকা পুরুষদের ভোলাও তোমরা, আবার পাদোদক নিতেও ছাড় না, এমনি কয়ে মাটি করলে এই জাতটাকে।” ‘সত্যি সত্যি, খুব সত্যি! ওই বােকাদের আমরা বসাই উচু বেদীতে, চােখের জলে কাদামাখা পা ধুইয়ে দিই, নিজেদের অপমানের শেষ করি, যত ভোলাই তার চেয়ে হাজার গুণে ভুলি।” পৃথীশ জিজ্ঞাসা করল, “এর উপায় কী।” বাঁশরি বললে, “তই তো বলি অন্তত লেখবার বেলায় সত্যি কথাটা লেখো। আর মস্তর নয় মাইথ'লজি নয়। মিনার্ভার মুখোশটা খুলে একবার দেখো। সেজোগুজে পানের ছিপে ঠোঁট লাল করে তোমাদের পানওয়ালি যে মস্তরটা ছড়ায়, ওই আশ্চর্য মেয়েও ভাষা বদলিয়ে সেই মস্তরই ছড়াচ্ছে। সামনে পড়েছে পথচলতি এক রাজা, তাকে ভোলাতে বসেছে কিসের জন্যে? টাকার জন্যে। শুনে রাখে, টাকা জিনিসটা মাইথ'লজি নয়, ওটা ব্যাঙ্কের। ওটা তোমাদের পৃথীশ বললে, “টাকার প্রতি ওঁর দৃষ্টি আছে সেটাতে বুদ্ধির পরিচয় পাওয়া গেল, সেইসঙ্গে হৃদয়টাও থাকতে পারে।” “আছে গো আছে। ঠিক জায়গায় খুঁজে দেখলে দেখতে পাবে পানওয়ালিরও হৃদয় আছে, কিন্তু টাকা এক দিকে হৃদয়টা আর-এক দিকে। এইটে যখন আবিষ্কার করবে। তখন গল্প জমবে। পাঠিকারা ঘোর আপত্তি করবে, বলবে মেয়েদের খেলো করা হল, অর্থাৎ তাদের মন্ত্রশক্তিতে বােকাদের মনে খটকা লাগানাে হচ্ছে। উচু দরের পুরুষ পাঠকেরা গালি পড়বে, তাদের মাইথ'লজির রঙ চটিয়ে দেওয়া, সর্বনাশ। কিন্তু ভয় কোরো না পৃথীশ, রঙ যখন যাবে জুলে, মন্ত্র যখন পড়বে চাঁপা- তখনো সত্য থাকবে টিকে।” “ওঁর হৃদয়ের ঠিকানা জিজ্ঞাসা করতে পারি কি? অসভ্যতা হবে, কিন্তু লেখক তো ড্রয়িংরুমের পোষা ভদ্রলোক নয়, সে অত্যন্ত আদিম শ্রেণীর সৃষ্টিকর্তা, চতুর্মুখের তুল্য কিংবা প্ৰলয়কর্তা দিগম্বরের স্বজাত।” “ঠিকানা বলতে হবে না, নিজের চোখেই দেখতে পাবে চোখ যদি থাকে। এখন চলো ওইদিকে, তোমাকে নিয়ে ওদের মধ্যে প্ৰসাদ ভাগ করে দেই গে।” “হাঁ, আমারই প্রসাদ। আমার নিন্দে দিয়েই এর স্বাদটা হয়ে উঠেছে উপাদেয়।” “দুঃখের কথা জানাই তোমাকে বাঁশরি। চাদরটাতে মস্ত একটা কালির দাগ। অন্যমনস্ক হয়ে দেখতে পাইনি।” “এখানে কারো কাপড়ে কোনো দাগ নেই, তা দেখেছ?” “তা হলে জিত রইল একা তোমারই। তুমি রিয়ালিস্ট, ওই কালীর দাগ তোমার ভূষণ। আজও খাটি হয়ে ওঠনি বলেই এতক্ষণ লজ্জা করছিলো।”