পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩২৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গ্রন্থপরিচয় ○○○ 'কালিঘাটের মন্দিরে দেবীপূজা-উপলক্ষ্যে পশুবলি নিষেধের উদ্দেশে আপনি যে শোকাবহ তাধ্যবসায়ে প্রবৃত্ত হইয়াছেন তাহা হইতে নিরস্ত করিবার জন্য আপনার দেশবাসী সকলের হইয়া আপনাকে সানুনয় অনুরোধ জানািহতেছি। আত্মজীবন-বলি দ্বারা বহুলোকের গভীর বেদনা সৃষ্টির 1রুদ্ধে ধন্মেরই দোহাই দিব। জীবজননীর নামে জীবহতার অপবিত্ৰতা নিবারণব্ৰতে দীক্ষাগুরু ও নেতৃরূপে দেশের লোককে উদ্বোধিত করিয়া দীর্ঘজীবন এই পুণ্যসাধনায় প্রবৃত্ত থাকিবেন এই আশা মনে লইয়া আপনার নিকট হইতে আপনার নিদারুণ পণটিকে ভিক্ষা চাহিতেছি, নিরাশ করিলেন না।” কিন্তু পত্রটি তাহাকে না পাঠাইয়া একই দিনে হীরেন্দ্রনাথকে লিখিলেন : “পণ্ডিত রামচন্দ্ৰ শৰ্মাকে প্রয়োপবেশন থেকে নিরস্ত করবার অনুরোধ জানিয়ে আপনি আমাকে পত্র লিখেছেন। তদনুসারে অনুনয় করে একটা চিঠি রচনা করেছিলুম। কিন্তু তার মহৎ সংকল্পের তুলনায় আমার অনুরোধটার দৈন্য এতই কৃশ বলে আমার চােখে ঠেকাল যে, লজ্জায় সেটাকে আপনাদের কাছে পাঠাতে পারলুম না। তিনি যে ব্ৰত নিয়েছেন সে চরম আত্মোৎসর্গের < 3. আমরা দুর্বলচিত্তে তার ফলাফল বিচার করবার অধিকারী নই। বাংলাদেশে শক্তিপূজায় "বরক্তপাত রোধ করা সহজ নয়। সে কথা নিশ্চিত- এই মহাত্মার প্রাণ উৎসর্গ করার আশু উদ্দেশ্য সফল হবে না জানি, কিন্তু এই উৎসর্গ করারই যে সার্থকতা তার তুলনা কোথায়। এ ক্ষেত্রে আমাদের নিজেদের সাধারণ আদর্শ অনুসারে চিন্তা করা খাটবে না। তার প্রাণ-উৎসর্গে আমরা বেদনা বোধ করব। সন্দেহ নেই, কিন্তু এই বেদনাতেই সেই উৎসর্গের মূল্য। কালীঘাটের মন্দিরে তঁর আত্মদানের কী ফল ফলবে জানি নে, কিন্তু এই দান আমাদের ইতিহাসের রত্নভাণ্ডারে নিত্য সঞ্চিত থাকবে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধারম্ভে অৰ্জ্জুনের প্রতি শ্ৰীকৃষ্ণের উপদেশ মনে পড়ল-- নিদারুণতার দ্বারা অভিভূত হয়ে পার্থের মনে যে ক্লৈব্য দেখা দিয়েছিল-- পণ্ডিত রামচন্দ্ৰ শৰ্মা জানেন কী তার স্বধৰ্ম এবং তিনি জানেন স্বধর্মে নিধনং শ্ৰেয়ঃ, আমরা কী জানি! প্রথমে যে সকরুণ পত্রটি লিখেছিলুম। সে পাঠাতে পারলুম না। ইতি ১৫ই ভাদ্র ১৩৪২ সম্ভবত এই চিঠিটিকেই বিবৃতির রূপ দিয়া সংবাদসংস্থা ইউনাইটেড প্রেস'কে দেওয়া ইয়াছিল (৩ সেপ্টেম্বর), যাহা ৫ সেপ্টেম্বর আনন্দবাজার পত্রিকা'য় মুদ্রিত হয়। এই বিষয়ে ‘বসুমতী'-সম্পাদক হেমেন্দ্ৰপ্ৰসাদ ঘোষকে রবীন্দ্রনাথ ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৩৫ একটি পত্রে লেখেন : 'শক্তিপূজায় এক সময় নরবলি প্রচলন ছিল, এখনও গোপনে কখনও কখনও ঘটে থাকে। এই প্ৰথা এখন রহিত হয়েছে। পশুহত্যাও রহিত হবে এই আশা করা যায়।” এই পত্রের সহিত তিনি জনৈক প্রশ্নকারীকে লিখিত তাহার উত্তরটিও পাঠাইয়া দেন : ‘বড়ো চিঠি লেখার মতো শক্তি ও উৎসাহ আমার নেই, সংক্ষেপে দুই একটা কথা বলি। জনসাধারণের মধ্যে চরিত্রের দুর্বলতা ও ব্যবহারের অন্যায় বহুব্যাপী, সেই জন্যে শ্ৰেয়ের বিশুদ্ধ আদর্শ ধর্মসাধনার মধ্যে রক্ষা করাই মানুষের পরিত্রাণের উপায়। নিজেদের আচরণের হোয়তার দোহাই দিয়ে সেই সর্বজনীন ও চিরন্তন আদর্শকে যদি দূষিত করা যায় তাহলে তার চেয়ে অপরাধ আর কিছু হতে পারে না। ঠগীরা দস্যবৃত্তি ও নরহত্যাকে তাদের ধর্মের অঙ্গ করেছিল। নিজের লুব্ধ ও হিংস্রপ্রবৃত্তিকে দেবদেবীর প্রতি আরোপ করে তাকে পুণ্য শ্রেণীতে ভুক্ত করাকে দেবনিন্দা পলব। এই আদর্শ-বিকৃতি থেকে দেশকে রক্ষা করার জনাে যিনি প্ৰাণ উৎসর্গ করতে প্ৰবৃত্ত, তিনি তা ধর্মের জন্যেই প্ৰাণ দিতে প্ৰস্তুত; শ্ৰীকৃষ্ণ অৰ্জ্জুনকে এই ধর্মের উদ্দেশ্যেই প্ৰাণ দিতে স্বয়ং উপদেশ দিয়েছিলেন। সেই উপদেশই রামচন্দ্ৰ শৰ্মা পালন করছেন। সাধারণ মানুষের হিংস্ৰতা নিষ্ঠুরতার অড় নেই- স্বয়ং ভগবান বুদ্ধ তাকে ਸf রোধ করতে পারেননি- তবুও ধর্ম অনুষ্ঠানে হিংস্রতার বিরুদ্ধে আত্মোৎসর্গের মতো দুন্ধর পুণ্যকৰ্ম আর কিছু হতে পারে কি না জানি ণে কিন্তু সেই প্ৰাণ-উৎসৰ্গই একটি মহৎ ফল। রামচন্দ্ৰ শৰ্মা আপনার প্রাণ দিয়ে নিরপরাধ পশুর খণ-ঘাতক ধর্মলোভী স্বজাতির কলঙ্ক ক্ষালন করতে বসেছেন এই জন্যে আমি তাকে নমস্কার করি। তিনি মহাপ্ৰাণ বলেই এমন কাজ তার দ্বারা সম্ভব হয়েছে। ইতি ২৪ ভাদ্র, ১৩৪২' -দুইটি