পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8\ኃ রবীন্দ্র-রচনাবলী মনে করেন যে, বিজ্ঞানদ্বারা জীবনতত্ত্ব বাহির হইলে ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিশ্বাস করিবার প্রয়োজন থাকে না, তাহার পুলকিত হইয়াছেন। তঁহাদের ভাবগতিক দেখিয়া খৃস্টান বৈজ্ঞানিকেরা তটস্থ এজন্য অধ্যাপক কোনো কোনাে বৈজ্ঞানিকের সহানুভূতি হইতে বঞ্চিত হইবেন। সুতরাং একাকী তীহাকে অনেক বিপক্ষের সহিত যুদ্ধ করিতে হইবে। তবে, যাহারা নিরপেক্ষ বিচারের অধিকারী, তাহারা উল্লসিত হইয়াছেন। তঁহারা বলেন, এমন ঘটনা হইয়াছে যে, যে সিদ্ধাস্তকে রয়াল সোসাইটি প্রথমে অবৈজ্ঞানিক বলিয়া পরিহার করিয়াছিলেন, বিশ বৎসর পরে পুনরায় তাহারা আদরের সহিত তাহা প্রকাশ করিয়াছেন। আচার্য জগদীশ যে মহৎ তত্ত্ব বৈজ্ঞানিক-সমাজে উপস্থিত করিয়াছেন, তাহার পরিণাম বহুদূরগামী। এক্ষণে আচার্যকে এই তত্ত্ব লইয়া সাহস ও নির্বন্ধের সহিত যুদ্ধ করিতে হইবে, ইহাকে সাধারণের নিকট প্রতিষ্ঠিত করিয়া। তবে তিনি বিশ্রাম করিতে পাইবেন। এ কাজ যিনি আরম্ভ করিয়াছেন, শেষ করা তাঁহারই সাধ্যায়ত্ত। ইহার ভার আর কেহ গ্ৰহণ করিতে পরিবে না। আচার্য জগদীশ বর্তমান অবস্থায় যদি ইহাকে অসম্পূর্ণ রাখিয়া যান, তবে ইহা নষ্ট হইবে। কিন্তু তাহার ছুটি ফুরাইয়া আসিল। শীঘ্রই তীহাকে প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপনাকার্যে যোগ দিতে আসিতে হইবে এবং তিনি তাহার অন্য কাজ বন্ধ করিতে বাধ্য হইবেন। কেবল অবসরের অভাবকে তেমন ভয় করি না। এখানে সর্বপ্রকার আনুকূল্যের অভাব। আচার্য জগদীশ কী করিতেছেন, আমরা তাহা ঠিক বুঝিতেও পারি না। এবং দুৰ্গতিপ্রাপ্ত জাতির স্বাভাবিক ক্ষুদ্রতাবশত আমরা বড়োকে বড়ো বলিয়া শ্রদ্ধা করিতে পারি না, শ্রদ্ধা করিতে চাহি-ও না। আমাদের শিক্ষা, সামর্থ্য, অধিকার যেমনই থাক, আমাদের স্পর্ধার অন্ত নাই। ঈশ্বর যে-সকল মহাত্মাকে এ দেশে কাজ করিতে পাঠান, তাহারা যেন বাংলা গবর্মেন্টের নোয়াখালিজেলায় কাৰ্যভার প্রাপ্ত হয়। সাহায্য নাই, শ্রদ্ধা নাই, প্রীতি নাই- চিত্তের সঙ্গ নাই, স্বাস্থ্য নাই, জনশূন্য মরুভূমিও ইহা অপেক্ষা কাজের পক্ষে অনুকূল স্থান; এই তো স্বদেশের লোক— এদেশীয় ইংরাজের কথা কিছু বলিতে চাহি না। এ ছাড়া যন্ত্ৰ-গ্ৰন্থ, সর্বদা বিজ্ঞানের আলোচনা ও পরীক্ষা ভারতবর্ষে সুলভ নহে। আমরা অধ্যাপক বসুকে অনুনয় করিতেছি, তিনি যেন তাহার কর্ম সমাধা করিয়া দেশে ফিরিয়া আসেন! আমাদের অপেক্ষা গুরুতর অনুনয় তাহার অন্তঃকরণের মধ্যে নিয়ত ধ্বনিত হইতেছে, তাহা আমরা জানি। সে অনুনয় সমস্ত ক্ষতি ও আত্মীয়বিচ্ছেদদুঃখ হইতেও বড়ো। তিনি সম্প্রতি নিঃস্বর্থ জ্ঞানপ্রচারের জন্য র্তাহার দ্বারে আগত প্রচুর ঐশ্বৰ্য-প্রলোভনকে অবজ্ঞাসহকারে প্রত্যাখ্যান করিয়াছেন, সে সংবাদ আমরা অবগত হইয়াছি, কিন্তু সে সংবাদ প্রকাশ করিবার অধিকার, আমাদের আছে না আছে, দ্বিধা করিয়া আমরা মৌন রহিলাম। অতএব এই প্রলোভনহীন পণ্ডিত জ্ঞানস্পাহাকেই সর্বোচ্চ রাখিয়া জ্ঞানে, সাধনায়, কর্মে এই হতচারিত্র হতভাগ্য দেশের গুরু ও আদর্শস্থানীয় হইবেন, ইহাই আমরা একান্তমনে কামনা করি। বঙ্গদর্শন আষাঢ়, ১৩০৮ জগদীশচন্দ্ৰ বসু তখন অল্প বয়স ছিল। সামনের জীবন ভোরবেলাকার মেঘের মতো; অস্পষ্ট কিন্তু নানা রঙে রঙিন। তখন মন রচনার আনন্দে পূর্ণ আত্মপ্রকাশের স্রোত নানা বীকে বঁকে আপনাতে আপনি বিস্মিত হয়ে চলেছিল; তীরের বাঁধ কোথাও ভাঙছে কোথাও গড়ছে; ধারা কোথায় গিয়ে মিশবে সেই সমাপ্তির চেহারা দূর থেকেও চােখে পড়ে নি। নিজের ভাগ্যের সীমারেখা তখনাে অনেকটা অনির্দিষ্ট আকারে ছিল বলেই নিত্য নূতন উদ্দীপনায় মন নিজের শক্তির নব নব পরীক্ষায় সর্বদা