পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

( N রবীন্দ্র-রচনাবলী প্রতিপত্তি ও আত্মনাম ঘোষণার মদমত্তত হইতে বহুদূরে একটি নির্দিষ্ট কর্মপ্রণালীর সংকীর্ণতার মধা দিয়া আপন তরুণ জীবনতরী যে শক্তিতে সতীশ প্রতিদিন বাহিয়া চলিয়াছিল, তাহা খেয়ালের জোরে নয়, প্রবৃত্তির বেগ নয়, ক্ষণিক উৎসাহের উদ্দীপনা নয়- তাহা তাহার মহান আত্মার স্বতঃস্ফুর্ত আত্মপরিতৃপ্ত শক্তি। বােলপুর ব্রহ্মবিদ্যালয়ের সম্বন্ধেই সতীশকে আমি নিকটে পাইয়াছিলাম, তাহার অন্তরাত্মার সহিত আমার যথার্থ পরিচয় ঘটিতেছিল। এই বিদ্যালয়ের কল্পনা আমার মনের মধ্যে যে কী ভাবের ভিত্তি অবলম্বন করিয়া উঠিয়াছে, তাহা বাক্ত করিয়া না বলিলে এ রচনা অসম্পূর্ণ থাকিবে। কয়েক বৎসর পূর্বে আমার কোনো বন্ধুকে আমি এই বিদ্যালয় সম্বন্ধে যে পত্র লিখিয়ছিলাম। এখানে তাহার কিয়দংশ উদ্ধৃত করা যাইতে পারে ‘মাঝে মাঝে আমি কল্পনা করি, পূর্বকালে ঋষিরা যেমন তপােবনে কুটির রচনা করিয়া পত্নী জ্ঞানপিপাসু জ্ঞানীরা যদি এই প্রান্তরের মধ্যে তপোবন রচনা করেন, তাহারা জীবিকাযুদ্ধ ও নগরের সংক্ষোভ হইতে দূরে থাকিয়া আপন আপন বিশেষ জ্ঞানচর্চায় রত থাকেন, তবে বঙ্গদেশ কৃতাৰ্থ হয়। অবশ্য, অশনবসনের প্রয়োজনকে খর্ব করিয়া জীবনের ভারকে লঘু করিতে হইবে। উপকরণের দাসতু হইতে নিজেকে মুক্ত করিয়া সর্বপ্রকার-বেষ্টন-হীন নির্মল আসনের উপর তপোনিরত মনকে প্রতিষ্ঠিত করিতে হইবে। যেমন শাস্ত্ৰে কাশীকে বলে পৃথিবীর বাহিরে, তেমনি সমস্ত ভারতবর্ষের মধ্যে এই একটুখানি স্থান থাকিবে- যাহা রাজা ও সমাজের সকলপ্রকার বন্ধনপীড়নের বাহিরে। ইংরাজ রাজা হউক, বা রুশ রাজা হউক, এই তপোকনের সমাধি কেহ ভঙ্গ করিতে পরিবে না। এখানে আমরা খণ্ডকালের অতীত ; আমরা সুদূর ভূতকাল হইতে সুদূর ভবিষ্যৎকাল পর্যন্ত ব্যাপ্ত করিয়া বাস করি; সনাতন যাজ্ঞবল্কা এবং অনাগত যুগান্তর আমাদের সমসাময়িক, কে আমাদের স্টেট সেক্রেটারি, কে আমাদের ভাইসরয়, কে কোন আইন করিল এবং কে সে আইন উল্টাইয়া দিল, আমরা সে খবর রাখি না। আকাশ তাহার গ্রহীতারকা, মেঘ-রৌদ্রে এবং প্রস্তুর তাহার তৃণগুলো ও ঋতুপর্যায়ে আমাদের প্রাতাহিক খবরের কাগজ। আমাদের তপোবনবাসীদের জন্ম-মৃত্যু-বিবাহের অনুষ্ঠানপরম্পরা, এখানকার নিভৃতশাস্তি ও সরল সৌন্দর্যের চিরন্তন সমারোহে সম্পন্ন হইতে থাকে। আমাদের বালকেরা হোমধেনু চরাইয়া আসিয়া পড়া লইতে বসে এবং বালিকারা গো-দােহনকার্য সারিয়া কুটিরপ্রাঙ্গণে, গৃহকাৰ্যে, শুচিস্নাত কল্যাণময়ী মাতৃদেবীর সহিত যোগ দেয়। 'জানি, আলোকের সঙ্গে ছায়া আসে, স্বগোদানেও শয়তানের গুপ্তসঞ্চার হইয়া থাকে, কিন্তু তাই বলিয়াই কি আলোককে রোধ করিয়া রাখিব এবং স্বর্গের আশা একেবারেই পরিত্যাগ করিতে হইবে? যদি বৈদিককালে তপোবন থাকে, যদি বৌদ্ধযুগে “নালন্দা' অসম্ভব না হয়, তবে আমাদের কালেই কি শয়তানের একাধিপত্য হইবে এবং মঙ্গলময় উচ্চ আদর্শমাত্রই মিলেনিয়ামের দুরাশা বলিয়া পরিহসিত হইতে থাকিবে? আমি আমার এই কল্পনাকে নিভৃতে পোষণ করিয়া প্রতিদিন সংকল্প আকারে পরিণত করিয়া তুলিতেছি। ইহাই আমাদের একমাত্র মুক্তি, আমাদের স্বাধীনতা, ইহাই আমাদের সর্বপ্রকার অবমাননা হইতে নিস্কৃতির একমাত্র উপায়। নহিলে আমরা আশ্রয় লইব কোথায়, আমরা বাঁচিব কী করিয়া। আমাদের মাথা তুলিবার স্থান তো নাই-ই, মাথা রাখিবারও স্থান প্রত্যহ সংকীর্ণ হইয়া আসিতেছে। প্রবল যুরোপ বন্যার মতো আসিয়া আমাদের সমস্তই পলে পলে তিলে তিলে অধিকার করিয়া লইল। এখন নিরাসক্ত চিত্ত, নিষ্কাম কর্ম, নিঃস্বাৰ্থ জ্ঞান এবং নির্বিকার অধ্যাত্মক্ষেত্রে আমাদিগকে আশ্রয় লইতে হইবে। সেখানে সৈনিকদের সহিত আমাদের বিরোধ নাই, বণিকদের সহিত আমাদের প্রতিযোগিতা নাই, রাজপুরুষদের সহিত আমাদের সংঘর্ষ নাই— সেখানে আমরা সকল আক্রমণের বাহিরে, সকল আগৌরবের উচে।” .