পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ঊনবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৪৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

199\ు রবীন্দ্র-রচনাবলী মুকুল বলে, ওইখানে নেবে গিয়ে থাকতে বেশ মজা ! ও মনে করে, এই নতুনকে প্রথম দেখার উত্তেজনা বুঝি চিরদিনই থাকবে ; ওখানে ওই ছোটাে ছোটাে পাহাড়গুলোর সঙ্গে গলা-ধরাধরি করে সমুদ্ৰ বুঝি চিরদিনই এই নতুন ভাষায় কানাকানি করে ; যেন ওইখানে পৌছলে পরে সমুদ্রের চঞ্চলনীল, আকাশের শাস্তনীল আর ওই পাহাড়গুলোর ঝাপসা-নীল ছাড়া আর কিছুর দরকারই হয় না। তার পরে, বিরল ক্রমে অবিরল হতে লাগল, ক্ষণে ক্ষণে আমাদের জাহাজ এক-একটা দ্বীপের গা ঘেঁষে চলল ; তখন দেখি দূরবীন টেবিলের উপরে অনাদরে পড়ে থাকে, মন আর সাড়া দেয় না। যখন দেখবার সামগ্ৰী বেড়ে ওঠে তখন দেখাটাই কমে যায়। নতুনকে ভোগ করে করে নতুনের খিদে ক্রমেই মরে যায়। হস্তাখানেক জাপানে আছি কিন্তু মনে হচ্ছে, যেন অনেক দিন আছি। তার মানে, পথঘাট, গাছপালা, লোকজনের যেটুকু নতুন সেটুকু তেমন গভীর নয়, তাদের মধ্যে যেটা পুরোনো সেইটেই পরিমাণে বেশি। অফুরান নতুন কোথাও নেই ; অর্থাৎ, যার সঙ্গে আমাদের চিরপরিচিত থাপ খায় না, জগতে এমন অসংগত কিছুই নেই। প্রথমে ধ" করে চোখে পড়ে, যেগুলো হঠাৎ আমাদের মনের অভ্যাসের সঙ্গে মেলে না। তার পরে পুরোনোর সঙ্গে নতুনের যে যে অংশের রঙে মেলে, চেহারায় কাছাকাছি আসে, মন তাড়াতাড়ি সেইগুলোকে পাশাপাশি সাজিয়ে নিয়ে তাদের সঙ্গে ব্যবহারে প্রবৃত্ত হয়। তাস খেলতে বসে আমরা হাতে কাগজ পেলে রঙ এবং মূল্য -অনুসারে তাদের পরে পরে সাজিয়ে নিই ; এও সেইরকম। শুধু তো নতুনকে দেখে যাওয়া নয়, তার সঙ্গে ষে ব্যবহার করতে হবে ; কাজেই মন তাকে নিজের পুরোনো কাঠামোর মধ্যে যত শীঘ্র পারে গুছিয়ে নেয়। যেই গোছানো হয় তখন দেখতে পাই, তত বেশি নতুন নয় যতটা গোড়ায় মনে হয়েছিল ; আসলে পুরোনো, ভঙ্গিটাই নতুন। তারপরে আর-এক মুশকিল হয়েছে এই যে,দেখতে পাচ্ছি, পৃথিবীর সকল সভ্য জাতই বর্তমান কালের ছাচে ঢালাই হয়ে একই রকম চেহারা অথবা চেহারার অভাব ধারণ করেছে। আমার এই জানলায় বসে কোবে শহরের দিকে তাকিয়ে এই যা দেখছি এ তো লোহার জাপান, এ তো রক্তমাংসের নয়। একদিকে আমার জানলা, আর-একদিকে সমুত্র, এর মাঝখানে প্রকাও একটা শহর। চীনেরা যেরকম বিকটমূর্তি ড্রাগন জাকে— সেইরকম। আঁকাবঁকা বিপুল দেহ নিয়ে সে যেন সবুজ পৃথিবীটিকে খেয়ে ফেলেছে। গায়ে গায়ে ঘেবাৰেষি লোহার চালগুলো ঠিক যেন তারই পিঠের আঁশের মতো রৌত্রে ঝকঝক করছে। বড়ো কঠিন, বড়ো কুৎসিৎ— এই দরকার-নামক দৈত্যটা। প্রকৃতির মধ্যে মানুষের যে অল্প আছে তা ফলে শস্তে বিচিত্র এবং স্বন্দর ; কিন্তু সেই অল্পকে যখন