পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ঊনবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৪২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

893 রবীন্দ্র-রচনাবলী তাকেই দেখতে পাই। বোলপুরের রাস্তায় গোরু, গাধা, গাড়ি উলটে ঝগড়ুর পা-ভাঙা প্রভৃতি দৃশ্বের দাম কিসেরই বা । চলতি ভাষায় যাকে মনোহর বলে এ তো তা নয়। কিন্তু, গল্পের বেগে তারা মনের সামনে এসে হাজির হচ্ছিল ; শিশুর মন তাদের প্রত্যেককেই স্বীকার করে নিয়ে বললে, “হা, এরা আছে।” এই বলে স্বহস্তে এদের কপালে অস্তিত্বগৌরবের টীকা পরিয়ে দিলে। এই দৃশ্যগুলি গল্প-বলার বেষ্টনীর মধ্যে একটি বিশেষ ঐক্য লাভ করেছিল। বিশ্বের ছাড়া-ছাড়া সমস্ত ছড়ানো তথ্যের অস্পষ্টতা থেকে স্বতন্ত্র হয়ে তারা সুনির্দিষ্ট হয়ে উঠেছিল। এই জোরে তারা কেবলই দাবি করতে লাগল “আমাকে দেখো!” সুতরাং, নন্দিনীর চোখের ঘুম আর টিকল না । কবি বল, চিত্রী বল, আপনার রচনার মধ্যে সে কী চায়। সে বিশেষকে চায়। বাতাসে ষে-অঙ্গারবাষ্প সাধারণভাবে আছে গাছ তাকে আত্মসাৎ ক’রে আপন ডালেপালায় ফলে ফুলে আপন ছন্দে রঙে অত্যন্ত বিশেষ করে যখন তোলে, তখনই তাতে স্বষ্টিলীলা প্রকাশ পায়। নীহারিকায় জ্যোতির্বাষ্প একটা একাকার ব্যাপার, নক্ষত্রআকারে বিশেষত্ব লাভ করায় তার সার্থকতা । মানুষের স্বষ্টিচেষ্টাও সেইরকম অনির্দিষ্ট সাধারণ থেকে স্বনির্দিষ্ট বিশেষকে জাগাবার চেষ্টা । আমাদের মনের মধ্যে নানা হৃদয়াবেগ ঘুরে বেড়ায়। ছন্দে স্বরে কথায় যখন সে বিশেষ হয়ে ওঠে তখন সে হয় কাব্য, সে হয় গান। হৃদয়াবেগকে প্রকাশ করা হল বলেই-যে আনন্দ তা নয় । তাকে বিশিষ্টতা দেওয়া হল বলেই আনন্দ । সেই বিশিষ্টতার উৎকর্ষেই তার উৎকর্ষ। মানুষের যে-কোনো রচনা সেই উৎকর্ষ পেয়েছে তাকেই আর্ট-স্বাক্টরূপে দেখি ; সেই একান্ত দেখাতেই আনন্দ । ইংরেজি ভাষায় ক্যারেকটার শব্দের একটা অর্থ, স্বভাব, নৈতিক চরিত্র ; আর-একটা অর্থ, চরিত্ররূপ। অর্থাৎ, এমন কতকগুলি গুণের এমন সমাবেশ যাতে এই সমাবেশটি বিশেষভাবে লক্ষ্যগোচর হয়। পূর্বেই বলেছি, এইরকম বিশেষ গোচরতাই আর্টের ধর্ম। নাট্যে কাব্যে চিত্রে নৈতিক সদগুণের চেয়ে এই ক্যারেক্টারের মূল্য বেশি। স্বাক্টর দিকে বিশেষত্ব এই তো আছে ক্যারেক্টার, স্বষ্টিকর্তার দিকে বিশেষত্ব প্রতিভায়। সেটা হচ্ছে দৃষ্টির বিশেষত্ব, অনুভূতির বিশেষত্ব, রচনার বিশেষত্ব নিয়ে। ভক্ত সমুদ্র-পৰ্বত-অরণ্যে স্বষ্টিকর্তার একটি স্বরূপ দেখতে পান, তাতেই সে-দৃশুগুলি বিশেষভাবে তার অন্তরঙ্গ হয়ে ওঠে। রূপকারের রচনাতেও তেমনি করেই স্রষ্টব্যক্তিটি আপন প্রতিভার স্বরূপ দিয়ে আপন স্বষ্টির রূপটিকে দ্রষ্টাব্যক্তিটির কাছে সুনির্দিষ্ট করে দেয়। তাতে যে-আনন্দ পাই সে সৌন্দর্যের বা স্বার্থকুদ্ধির শুভবুদ্ধির আনন্দ নয়, বিশেষকে ব্যক্ত দেখার আনন্দ । আমার ভিতরকার ব্যক্তি সেই পরিব্যক্তিতে নিজেরই