পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৮০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

९¢२ রবীন্দ্র-রচনাবলী ফণিভূষণের স্ত্রী মণিমালিক, বিনা চেষ্টায় আদর, বিনা অশ্রুবর্ষণে ঢাকাই শাড়ি এবং বিনা ঘুর্জয় মানে বাজুবন্ধ লাভ করিত। এইরূপে তাহার নারীপ্রকৃতি এবং সেই সঙ্গে তাহার ভালোবাসা নিশ্চেষ্ট হইয়া গিয়াছিল ; সে কেবল গ্রহণ করিত, কিছু দিত না। তাহার নিরীহ এবং নির্বোধ স্বামীটি মনে করিত, দানই বুঝি প্রতিদান পাইবার উপায়। একেবারে উলটা বুঝিয়াছিল আর কি। ইহার ফল হইল এই যে, স্বামীকে সে আপন ঢাকাই শাড়ি এবং বাজুবন্ধ জোগাইবার যন্ত্রস্বরূপ জ্ঞান করিত ; যন্ত্রটিও এমন স্বচারু যে, কোনোদিন তাহার চাকায় এক ফোটা তেল জোগাইবারও দরকার হয় নাই । ফণিভূষণের জন্মস্থান ফুলবেড়ে, বাণিজ্যস্থান এখানে । কর্মস্থরোধে এখানেই তাহাকে অধিকাংশ সময় থাকিতে হইত। ফুলবেড়ের বাড়িতে তাহার মা ছিল না, তবু পিসি মাসি ও অন্য পাঁচজন ছিল। কিন্তু, ফণিভূষণ পিসি মালি ও অন্য পাচজনের উপকারার্থেই বিশেষ করিয়া স্বন্দরী স্ত্রী ঘরে আনে নাই। স্বতরাং স্ত্রীকে সে পাচজনের কাছ থেকে আনিয়া এই কুঠিতে একলা নিজের কাছেই রাখিল । কিন্তু অন্যান্য অধিকার হইতে স্ত্রী-অধিকারের প্রভেদ এই যে, স্ত্রীকে পাচজনের কাছ হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া একলা নিজের কাছে রাখিলেই যে সব সময় বেশি করিয়া পাওয়া যায় তাহা নহে। স্ত্রীটি বেশি কথাবার্তা কহিত না, পাড়া প্রতিবেশিনীদের সঙ্গেও তাহার মেলামেশা বেশি ছিল না ; ব্রত উপলক্ষ্য করিয়া দুটো ব্রাহ্মণকে খাওয়ানো বা বৈষ্ণবীকে দুটো পয়সা ভিক্ষা দেওয়া কখনো তাহার দ্বারা ঘটে নাই । তাহার হাতে কোনো জিনিস নষ্ট হয় নাই ; কেবল স্বামীর আদরগুলা ছাড়া আর যাহা পাইয়াছে সমস্তই জমা করিয়া রাখিয়াছে। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, সে নিজের অপরূপ যৌবনত্ৰ হইতেও যেন লেশমাত্র অপব্যয় ঘটিতে দেয় নাই । লোকে বলে, তাহার চব্বিশবৎসর বয়সের সময়ও তাহাকে চোদ্ধবৎসরের মতো কাচা দেখিতে ছিল যাহাদের হৃৎপিগু বরফের পিও, ষাহীদের বুকের মধ্যে ভালোবাসার জালাযন্ত্রণা স্থান পায় না, তাহারা বোধ করি স্বদীর্ঘকাল তাজা থাকে, তাহারা কৃপণের মতো অস্তরে বাহিরে আপনাকে জমাইয়া রাখিতে পারে। ঘনপল্পবিত অতিসতেজ লতার মতো বিধাতা মণিমালিকাকে নিফলা করিয়া রাখিলেন, তাহাকে সস্তান হইতে বঞ্চিত করিলেন । অর্থাৎ, তাহাকে এমন একটা কিছু দিলেন না যাহাকে সে আপন লোহার লিন্দুকের মণিমাণিক্য অপেক্ষ বেশি করিয়া বুঝিতে পারে, যাহা বসন্তপ্রভাতের নবশ্বর্ষের মতো আপন কোমল উত্তাপে তাহার হৃদয়ের বরফপিগুটী গলাইয়া সংসারের উপর একটা স্নেহনির্বর বহাইয়া দেয় ।