পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৬৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দুই বোন। 88t বোধ করত। তাই, ইদানীং আপন সেবাপরায়ণ হৃদয়ের দাবি অনেক পরিমাণেই কমিয়ে এনেছে। ও বলত, পুরুষমানুষ রাজার জাত, দুঃসাধ্য কর্মের অধিকার ওদের নিয়তই প্রশস্ত করতে হবে। নইলে তারা মেয়েদের চেয়েও নিচু হয়ে যায়। কেননা, মেয়েরা আপন স্বাভাবিক মাধুর্বে, ভালোবাসার জন্মগত ঐশ্বৰ্বেই, সংসারে প্রতিনি আপন আসনকে সহজেই সার্থক করে। কিন্তু পুরুষের নিজেকে সার্থক করতে হয় প্রত্যহ যুদ্ধের দ্বারা। সে কালে রাজার বিনা প্রয়োজনেই রাজ্যবিস্তার করতে বেরোত । রাজ্যলোভের জন্তে নয়, নূতন করে পৌরুষের গৌরব প্রমাণের জন্তে। এই গৌরবে মেয়ের যেন বাধা না দেয়। শৰ্মিলা বাধা দেয় নি, ইচ্ছা করেই শশাঙ্ককে তার লক্ষ্য-সাধনায় সম্পূর্ণ পথ ছেড়ে দিয়েছে। এক সময়ে তাকে ওর সেবাজালে জড়িয়ে ফেলেছিল, মনে দুঃখ পেলেও সেই জালকে ক্রমশ খর্ব করে এনেছে। এখনো সেবা যথেষ্ট করে, অদৃপ্তে, নেপথ্যে । হায়'রে, আজ ওর স্বামীর এ কী পরাভব দিনে দিনে প্রকাশ হয়ে পড়ছে। রোগশয্যা থেকে সব ও দেখতে পায় না, কিন্তু যথেষ্ট আভাস পায়। শশাঙ্কের মুখ দেখলেই বুঝতে পারে, সে যেন সর্বদাই কেমন আবিষ্ট হয়ে আছে। ঐ একরত্তি মেয়েটা এসে অল্প এই ক’দিনেই এত বড়ো সাধনার আসন থেকে ঐ কর্মকঠিন পুরুষকে বিচলিত করে দিলে। আজ স্বামীর এই অশ্রদ্ধেয়ত শমিলাকে রোগের বেদনার চেয়েও বেশি করে বাজছে । শশাঙ্কের আহারবিহার বেশবাসের চিরাচরিত ব্যবস্থায় নানা-রকম ক্রটি হচ্ছে সন্দেহ নেই। যে পথ্যটা তার বিশেষ রুচিকর সেটাই খাবার সময় হঠাৎ দেখা যায় অবর্তমান । তার কৈফিয়ত মেলে, কিন্তু কোনো কৈফিয়তকে এ সংসার এত দিন আমল দেয় নি। এ-সব অনবধানতা ছিল অমার্জনীয়, কঠোর শাসনের যোগ্য ; সেই বিধিবদ্ধ সংসারে আজ এত বড়ে যুগান্তর ঘটেছে যে, গুরুতর ক্রটিগুলোও প্রহসনের মতো হয়ে উঠল। দোষ দেবে কাকে । দিদির নির্দেশমত উমি যখন রান্নাঘরে বেতের মোড়ার উপর বসে পাকপ্রণালীর পরিচালনকার্যে নিযুক্ত, সঙ্গে সঙ্গে পাচক-ঠাকরুনের পূর্বজীবনের বিবরণগুলির পর্যালোচনাও চলছে, এমন সময় শশাঙ্ক হঠাৎ এসে বলে, *ও-সব এখন থাকৃ।” “কেন, কী করতে হবে ?” *আমার এ বেলা ছুটি আছে, চলো, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের বিলডিংটা দেখবে। ওটার গুমর দেখলে হাসি পায় কেন তোমাকে বুঝিয়ে দেব।” এত বড়ো প্রলোভনে কর্তব্যে ফাকি দিতে উমির মনও তৎক্ষণাৎ চঞ্চল হয়ে ওঠে।