পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৩৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

WSO রবীন্দ্র-রচনাবলী আমাদের তখনকার সেই নবীন অধ্যাপকটি আজকালকার একজন সুবিখ্যাত লোক, অতএব আমার এই জীবনবৃত্তান্তে তাহার নাম গোপন করিলেও তাহার উজ্জ্বল নামের বিশেষ ক্ষতি হইবে না। আমার প্রতি তাহার আচরণ লক্ষ করিয়া বর্তমান ইতিহাসে তাহাকে বামাচরণবাবু বলিয়া ডাকা যাইবে । ইহার বয়স যে আমাদের অপেক্ষা অধিক ছিল তাহা নহে ; অল্পদিন হইল এম. এ. পরীক্ষায় প্রথম হইয়া টনি সাহেবের বিশেষ প্ৰশংসা লাভ করিয়া বাহির হইয়া আসিয়াছেন, কিন্তু লোকটি ব্ৰাহ্ম বলিয়া কেমন তাহাকে অত্যন্ত সুদূর এবং স্বতন্ত্ৰ মনে হইত, আমাদের সমকালীন সমবয়স্ক বলিয়া বোধ হইত না। আমরা নব্যহিন্দুর দল পরস্পরের মধ্যে তঁহাকে ব্ৰহ্মদৈত্য বলিয়া ডাকিতাম । আমাদের একটি তর্কসভা ছিল । আমি সে সভার বিক্রমাদিত্য এবং আমিই সে সভার নবরত্ন ছিলাম । আমরা ছত্রিশজন সভ্য ছিলাম, তন্মধ্যে পয়ত্ৰিশ জনকে গণনা হইতে বাদ দিলে কোনো ক্ষতি হইত না এবং অবশিষ্ট একজনের যোগ্যতা সম্বন্ধে আমার যেরূপ ধারণা উক্ত পয়ত্ৰিশ জনেরও সেইরূপ ধারণা ছিল । এই সভার বার্ষিক অধিবেশন উপলক্ষে আমি কার্লাইলের সমালোচনা করিয়া এক ওজস্বী প্ৰবন্ধ রচনা করিয়াছিলাম। মনে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, তাহার অসাধারণত্বে শ্রোতামাত্রেই চমৎকৃত হইবেচমৎকৃত হইবার কথা ছিল, কারণ, আমার প্রবন্ধে কার্লাইলকে আদ্যোপােন্ত নিন্দা করিয়াছিলাম । সে অধিবেশনে সভাপতি ছিলেন বামাচরণবাবু। প্ৰবন্ধপাঠ শেষ হইলে আমার সহাধ্যায়ী ভক্তগণ আমার মতের অসমসাহসিকতা ও ইংরাজিভাষায় বিশুদ্ধ তেজস্বিতায় বিমুগ্ধ ও নিরুত্তর হইয়া বসিয়া রহিল। কাহারও কিছু বক্তব্য নাই শুনিয়া বামাচরণবাবু উঠিয়া শান্তগষ্ঠীর স্বরে সংক্ষেপে বুঝাইয়া দিলেন যে, আমেরিকার সুলেখক সুবিখ্যাত লাউয়েল সাহেবের প্রবন্ধ হইতে আমার প্রবন্ধটির যে-অংশ চুরি সে-অংশ অতি চমৎকার, এবং যে-অংশ আমার সম্পূর্ণ নিজের সেটুকু পরিত্যাগ করিলেই ভালো হইত । যদি তিনি বলিতেন, লাউয়েলের সহিত নবীন প্ৰবন্ধলেখকের মতের এমন-কি, ভাষারও আশ্চর্য অবিকল ঐক্য দেখা যাইতেছে, তাহা হইলে তাহার কথাটা সত্যও হইত। অথচ অপ্ৰিয়ও হইত না । এই ঘটনার পর, সহপাঠীমহলে আমার প্রতি যে অখণ্ড বিশ্বাস ছিল তাহতে একটি বিদারণরেখা পড়িল । কেবল আমার চিরানুরক্ত ভক্তাগ্রগণ্য অমূল্যচরণের হৃদয়ের লেশমাত্র বিকার জন্মিল না । সে আমাকে বারংবার বলিতে লাগিল, “তোমার বিদ্যাপতি নাটকখানা ব্ৰহ্মদৈত্যকে শুনাইয়া দাও, দেখি সে সম্বন্ধে নিন্দুক কী বলিতে পারে।” রাজা শিবসিংহের মহিষী লছিমাদেবীকে কবি বিদ্যাপতি ভালোবাসিতেন এবং তাহাকে না দেখিলে তিনি কবিতা রচনা করিতে পারিতেন না । এই মর্ম অবলম্বন করিয়া আমি একখানি পরম শোকাবহ উচ্চশ্রেণীর পদ্যনাটক রচনা করিয়াছিলাম ; আমার শ্রোতৃবর্গের মধ্যে যাহারা পুরাতত্ত্বের মর্যাদা লঙ্ঘন করিতে চাহেন না। তাহারা বলিতেন, ইতিহাসে এরাপ ঘটনা ঘটে নাই । আমি বলিতাম, সে ইতিহাসের দুৰ্ভাগ্য ! ঘটিলে ইতিহাস ঢের বেশি সরস ও সত্য হইত । নাটকখানি যে উচ্চশ্রেণীর সে কথা আমি পূর্বেই বলিয়াছি। অমূল্য বলিত সর্বোচ্চশ্রেণীর। আমি আপনাকে যতটা মনে করিতাম, সে আবার আমাকে তাহারও চেয়ে বেশি মনে করিত । অতএব, আমার যে কী এক বিরাট রূপ তাহার চিত্তে প্ৰতিফলিত ছিল, আমিও তাহার ইয়াত্তা করিতে পারিতাম R | নাটকখানি বামাচরণবাবুকে শুনাইয়া দিবার পরামর্শ আমার কাছে মন্দ লাগিল না ; কারণ, সে নাটকে নিন্দযোগ্য ছিদ্র লেশমাত্র ছিল না। এইরূপ আমার সুদৃঢ় বিশ্বাস। অতএব, আর-একদিন তর্কসভার বিশেষ অধিবেশন আহুত হইল, ছাত্রবৃন্দের সমক্ষে আমি আমার নাটকখানি পাঠ করিলাম এবং বামাচরণবাবু তাহার সমালোচনা করিলেন । সে সমালোচনাটি বিস্তারিত আকারে লিপিবদ্ধ করিবার প্রবৃত্তি আমার নাই। সংক্ষেপত, সমালোচনাটি আমার অনুকুল হয় নাই ; বামাচরণবাবুর মতে নাটকগত পাত্ৰগণের চরিত্র ও