পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৪৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

v2N2O রবীন্দ্র-রচনাবলী বাজিল, সে আগ্রহসহকারে বলিয়া উঠিল, “না না, ও বই থাকা ।” আমি কিয়দদূরে একটা ধাপ নীচে বসিয়া ইংরাজি কাব্যসাহিত্যের কথা উত্থাপন করিলাম, এমন করিয়া কথা তুলিলাম যাহাতে কিরণেরও সাহিত্যশিক্ষা হয় এবং আমারও মনের কথা ইংরাজ কবির জবানিতে ব্যক্ত হইয়া উঠে। খররৌদ্রতাপে সুগভীর নিন্তব্ধতার মধ্যে জলের স্থলের ছোটাে ছোটাে কলশব্দগুলি নিদ্রাকাতর জননীর ঘুমপাড়ানি গানের মতো অতিশয় মৃদু এবং সকরুণ হইয়া আসিল । কিরণ যেন অধীর হইয়া উঠিল ; কহিল, “বাবা একা বসিয়া আছেন, অনন্ত আকাশ সম্বন্ধে আপনাদের সে তর্কটা শেষ করিবেন না ?” আমি মনে মনে ভাবিলাম, অনন্ত আকাশ তো চিরকাল থাকিবে এবং তােহর সম্বন্ধে তর্কও তো কোনোকালে শেষ হইবে না ; কিন্তু জীবন স্বল্প এবং শুভ অবসর দুর্লভ ও ক্ষণস্থায়ী । কিরণের কথার উত্তর না দিয়া কহিলাম, “আমার কতকগুলি কবিতা আছে, আপনাকে শুনাইব ।” কিরণ কহিল, “কাল শুনিব ।” বলিয়া একেবারে উঠিয়া ঘরের দিকে চাহিয়া বলিয়া উঠিল, “বাবা, মহীন্দ্রবাবু আসিয়াছেন।” ভাবনাথবাবু নিদ্রাভঙ্গে বালকের ন্যায় তাহার সরল নেত্রদ্বয় উমীলন করিয়া ব্যস্ত হইয়া উঠিলেন । আমার বক্ষে যেন ধক করিয়া একটা মন্ত ঘা লাগিল । ভবনাথবাবুর ঘরে গিয়া অনন্ত আকাশ সম্বন্ধে তর্ক করিতে লাগিলাম। কিরণ বই হাতে লইয়া দোতলায় বোধ হয় তাহার নির্জন শয়নকক্ষে নির্বিঘ্নে পড়িতে গেল । পরদিন সকালের ডাকে লালপেন্সিলের দাগ-দেওয়া একখানা স্টেটসম্যান কাগজ পাওয়া গেল, তাহাতে বি. এ. পরীক্ষার ফল বাহির হইয়াছে। প্রথমেই প্ৰথম ডিবিশান-কোঠায় কিরণবালা বন্দ্যোপাধ্যায় বলিয়া একটা নাম চোখে পড়িল ; আমার নিজের নাম প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় কোনো বিভাগেই নাই । পরীক্ষায় অকৃতাৰ্থ হইবার বেদনার সঙ্গে সঙ্গে বজাগ্নির ন্যায় একটা সন্দেহ বাজিতে লাগিল যে, কিরণবালা বন্দ্যোপাধ্যায় হয়তো আমাদেরই কিরণবালা । সে-যে কলেজে পড়িয়াছে বা পরীক্ষা দিয়াছে, এ কথা যদিও আমাকে বলে নাই। তথাপি সন্দেহ ক্রমেই প্রবল হইতে লাগিল । কারণ, ভাবিয়া দেখিলাম, বৃদ্ধ পিতা এবং তাহার কন্যাটি নিজেদের সম্বন্ধে কোনো কথাই কখনো আলাপ করেন নাই, এবং আমিও নিজের আখ্যান বলিতে এবং নিজের বিদ্যা প্রচার করিতে সর্বদাই এমন নিযুক্ত ছিলাম যে, তঁহাদের কথা ভালো করিয়া জিজ্ঞাসাও করি নাই। জার্মানপণ্ডিত-রচিত আমার নূতন-পড়া দর্শনের ইতিহাস সম্বন্ধীয় তর্কগুলি আমার মনে পড়িতে লাগিল, এবং মনে পড়িল, আমি একদিন কিরণকে বলিয়াছিলাম, “আপনাকে যদি আমি কিছুদিন গুটিকতক বই পড়াইবার সুযোগ পাই তাহা হইলে ইংরাজি কাব্যসাহিত্য সম্বন্ধে আপনার একটা পরিকার ধারণা জন্মাইতে পারি ।” কিরণবালা দর্শনশাস্ত্ৰে অনার লইয়াছেন এবং সাহিত্যে প্ৰথম শ্রেণীতে উত্তীৰ্ণ । যদি এই কিরণ श ! অবশেষে প্রবল খোচা দিয়া আপন ভস্মাচ্ছন্ন অহংকারকে উদ্দীপ্ত করিয়া কহিলাম, “হয় হউক।-- আমার রচনাবলী আমার জয়ন্ত্যন্ত ।” বলিয়া খাতা-হাতে সবলে পা ফেলিয়া মাথা পূর্বাপেক্ষা উচ্চে তুলিয়া ভাবনাথবাবুর বাগানে গিয়া উপস্থিত হইলাম । তখন তাহার ঘরে কেহ ছিল না। আমি একবার ভালো করিয়া বৃদ্ধের পুস্তকগুলি নিরীক্ষণ করিতে লাগিলাম । দেখিলাম, এক কোণে আমার সেই নব্য জার্মান পণ্ডিত-রচিত দর্শনের ইতিহাসখানি অনাদরে পড়িয়া রহিয়াছে ; খুলিয়া দেখিলাম, ভাবনাথবাবুর স্বহন্তলিখিত নোটে তাহার মার্জিন পরিপূর্ণ। বৃদ্ধ নিজে তাহার কন্যাকে শিক্ষা দিয়াছেন । আমার আর সন্দেহ রহিল না । ভবনাথবাবু অন্যদিনের অপেক্ষা প্ৰসন্নজ্যোতিবিদছুরিত মুখে ঘরে আসিয়া প্রবেশ করিলেন, যেন কোনো সুসংবাদের নির্বরধারায় তিনি সদ্য প্ৰাতঃস্নান করিয়া আসিয়াছেন। আমি অকস্মাৎ কিছু দত্যের