পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৪৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VVS क्षेीझ-बाष्प्नातुर्की এই প্ৰমথনাথ একবার বছর তিনকের জন্য বিলাতে ভ্ৰমণ করিয়া আসিয়াছিলেন । সেখানে ইংরাজের সৌজন্যে মুগ্ধ হইয়া ভারতবর্ষের অপমানদুঃখ সমস্ত ভুলিয়া ইংরাজি সাজ পরিয়া দেশে ফিরিয়া আসেন । ভাইবোনেরা প্রথমটা একটু কুষ্ঠিত হইল, অবশেষে দুইদিন পরে বলিতে লাগিল, ইংরাজি কাপড়ে দাদাকে যেমন মানায় এমন আর-কাহাকেও না । ইংরাজি বস্ত্রের গৌরবগর্ব পরিবারের অন্তরের মধ্যে ধীরে ধীরে সঞ্চারিত হইল । প্রমথনাথ বিলাত হইতে মনে ভাবিয়া আসিয়াছিলেন "কী করিয়া ইংরাজের সহিত সমপৰ্যায় রক্ষা করিয়া চলিতে হয় আমি তাহারই অপূর্ব দৃষ্টান্ত দেখাইব'— নত না হইলে ইংরাজের সহিত মিলন হয় না। এ কথা যে বলে সে নিজের হীনতা প্ৰকাশ করে এবং ইংরাজকেও অন্যায় অপরাধী করিয়া থাকে । প্রমথনাথ বিলাতের বড়ো বড়ো লোকের কাছ হইতে অনেক সাদরপত্র আনিয়া ভারতবর্ষীয় ইংরাজমহলে কিঞ্চিৎ প্রতিপত্তি লাভ করিলেন । এমন-কি, মধ্যে মধ্যে সস্ত্রীক ইংরাজের চা ডিনার খেলা এবং হাস্যকৌতুকের কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ ভাগ পাইতে লাগিলেন । সৌভাগ্যমদমত্ততায় ক্রমশই তাহার শিরা-উপশিরাগুলি অল্প অল্প রীরী করিতে শুরু করিল। এমন সময়ে একটি নূতন রেলওয়ে লাইন খোলা উপলক্ষে রেলওয়ে কোম্পানির নিমন্ত্রণে ছোটােলাটের সঙ্গে দেশের অনেকগুলি রাজপ্ৰসাদগর্বিত সম্রান্তলোকে গাডি বোঝাই করিয়া নবলীেহপথে যাত্ৰা করিলেন । প্রমথনাথও তাহার মধ্যে ছিলেন । ফিরিবার সময় একটা ইংরাজ দারোগা দেশীয় বড়োলোকদিগকে কোনো-এক বিশেষ গাড়ি হইতে অত্যন্ত অপমানিত করিয়া নামাইয়া দিল । ইংরাজবেশধারী প্রমথনাথও মানে মানে নামিয়া পডিবার উপক্ৰম করিতেছেন দেখিয়া দারোগা কহিল, “আপনি উঠিতেছেন কেন, আপনি বসুন-না৷ ” এই বিশেষ সম্মানে প্রমথনাথ প্রথমটা একটু স্ফীত হইয়া উঠিলেন । কিন্তু, যখন গাড়ি ছাড়িয়া দিল, যখন তৃণহীন কর্ষণ ধূসর পশ্চিম প্রান্তরের প্রান্তসীমা হইতে স্নান সূর্যস্ত-আভা সকরুণরক্তিম লজ্জার মতো সমস্ত দেশের উপর যেন পরিব্যাপ্ত হইয়া পড়িল এবং যখন তিনি একাকী বসিয়া বাতায়নপথ হইতে অনিমেষনয়নে বনান্তরালবাসিনী কুষ্ঠিতা বঙ্গভূমির প্রতি নিরীক্ষণ করিয়া ভাবিতে লাগিলেন, তখন ধিক্কারে তাহার হৃদয় বিদীর্ণ হইল এবং দুই চক্ষু দিয়া অগ্নিজ্বালাময়ী অশ্রুধারা পড়িতে লাগিল । তাহার মনে একটা গল্পের উদয় হইল । একটি গর্দভ রাজপথ দিয়া দেবপ্রতিমার রথ টানিয়া চলিতেছিল, পথিকবর্গ তাহার সম্মুখে ধূলায় লুষ্ঠিত হইয়া প্রতিমাকে প্ৰণাম করিতেছিল এবং মৃঢ় গর্দভ। আপন মনে ভাবিতেছিলেন, “সকলে আমাকেই সম্মান করিতেছে ।” প্রমথনাথ মনে মনে কহিলেন, “গদর্ভের সহিত আমার এই একটু প্ৰভেদ দেখিতেছি, আমি আজ বুঝিয়াছি, সম্মান আমাকে নহে, আমার স্কন্ধের বোঝাগুলাকে ৷” প্রমথনাথ বাড়ি আসিয়া বাড়ির ছেলেপূলে সকলকে ডাকিয়া একটা হােমাগ্নি জ্বালাইলেন এবং বিলাতি বেশভূষাগুলো একে একে আহুতিস্বরূপ নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন । শিখা যতই উচ্চ হইয়া উঠিল ছেলেরা ততই উচ্ছসিত আনন্দে নৃত্য করিতে লাগিল । তাহার পর হইতে প্রমথনাথ ইংরাজঘরের চায়ের চুমুক এবং রুটির টুকরা পরিত্যাগ করিয়া পুনশ্চ গৃহকোণদুর্গের মধ্যে দুৰ্গম হইয়া বসিলেন, এবং পূর্বোক্ত লাঞ্ছিত উপাধিধারীগণ পূর্ববৎ ইংরাজের দ্বারে দ্বারে উষ্ণীয্য আন্দোলিত করিয়া ফিরিতে লাগিল । দৈবদূর্যোগে দূৰ্ভাগ্য নবেন্দুশেখর এই পরিবারের একটি মধ্যমা ভগিনীকে বিবাহ করিয়া বসিলেন । বাড়ির মেয়েগুলি লেখাপড়াও যেমন জানে দেখিতে শুনিতেও তেমনি ; নবেন্দু ভাবিলেন, "বড়ো জিতিলাম ।” কিন্তু “আমাকে পাইয়া তোমরাও জিতিয়াছ' এ কথা প্ৰমাণ করিতে কালবিলম্ব করিলেন না । কোন সাহেব তাহার বাবাকে কবে কী চিঠি লিখিয়াছিল তাহা যেন নিতান্ত ভ্রমবশত দৈবক্রমে পকেট হইতে