পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৫৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

5国3丐 SJ ○ বেহােরার, কতটা অংশ লাবণ্য, তাহা নৈতিক গণিতশাস্ত্রের একটা সূক্ষ্ম সমস্যা । টিকটিকির কাটা লেজ যেমন সম্পূর্ণ অন্ধভাবে ধড়ফড় করে, নবেন্দুর ক্ষুব্ধ হৃদয় ভিতরে ভিতরে তেমনি আছাড় খাইতে লাগিল । সমস্তদিন খাইতে শুইতে আর সোয়ন্তি রহিল না । লাবণ্য আভ্যন্তরিক হাস্যের সমস্ত আভাস মুখ হইতে সম্পূর্ণ দূর করিয়া দিয়া উদবিগ্নভাবে থাকিয়া থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল, “আজ তোমার কী হইয়াছে বলে দেখি ! অসুখ করে নাই তো ?” নবেন্দু কায়ক্লেশে হাসিয়া কোনোমতে একটা দেশকলপাত্ৰোচিত উত্তর বাহির করিল ; কহিল, “তোমার এলেকার মধ্যে আবার অসুখ কিসের । তুমি আমার ধন্বন্তরিনী।” কিন্তু, মুহুর্তমধ্যেই হাসি মিলাইয়া গেল এবং সে ভাবিতে লাগিল, “একে আমি কনগ্রেসে চান্দা দিলাম, কাগজে কড়া চিঠি লিখিলাম, তাহার উপরে ম্যাজিস্ট্রেট নিজে আমার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিলেন, আমি তাহাকে বসাইয়া রাখিলাম, না জানি কী মনে করিতেছেন ' ‘হা তাত, হা পূর্ণেন্দুশেখর ! আমি যাহা নাই ভাগ্যের বিপাকে গোলেমালে তাঁহাই প্ৰতিপন্ন হইলাম ।” পরদিন সাজগোজ করিয়া ঘড়ির চেন বুলাইয়া মস্ত একটা পাগড়ি পরিয়া নবেন্দু বাহির হইল । লাবণ্য জিজ্ঞাসা করিল, “যাও কোথায় ।” নবেন্দু কহিল, “একটা বিশেষ কাজ আছে—” লাবণ্য কিছু বলিল না । সাহেবের দরজার কাছে কার্ড বাহির করিবামাত্র আরদালি কহিল, “এখন দেখা হইবে না ।” নবেন্দু পকেট হইতে দুইটা টাকা বাহির করিল। আরদালি সংক্ষিপ্ত সেলাম করিয়া কহিল, “আমরা পাঁচজন আছি।” নবেন্দু তৎক্ষণাৎ দশ টাকার এক নোট বাহির করিয়া দিলেন । সাহেবের নিকট তলব পড়িল । সাহেব, তখন চটিজুতা ও মনিংগীেন পরিয়া লেখাপড়ার কাজে নিযুক্ত ছিলেন । নবেন্দু একটা সেলাম করিলেন, ম্যাজিষ্ট্রেট র্তাহাকে অঙ্গুলিসংকেতে বসিবার অনুমতি করিয়া কাগজ হইতে মুখ না তুলিয়া কহিলেন, “কী বলিবার আছে, বাবু।” নবেন্দু ঘড়ির চেন নাড়িতে নাড়িতে বিনীত কম্পিত স্বরে বলিল, “কাল আপনি অনুগ্রহ করিয়া আমার সহিত সাক্ষাৎ করিতে গিয়াছিলেন, কিন্তু-” সাহেব প্ৰকৃঞ্চিত করিয়া একটা চোখ কাগজ হইতে তুলিয়া বলিলেন, “সাক্ষাৎ করিতে গিয়াছিলাম ! Babu, what nonsense are you talking " নবেন্দু “Beg your pardon ! ভূল হইয়াছে, গোল হইয়াছে” করিতে করিতে ঘর্মগ্নত কলেবরে কোনোমতে ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিলেন । এবং সে রাত্রে বিছানায় শুইয়া কোনো দূরস্বপ্নশ্রুত মন্ত্রের ন্যায় একটা বাক্য থাকিয়া থাকিয়া তাহার কানে আসিয়া প্রবেশ করিতে লাগিল, “Babu, you are a howling idiot" পথে আসিতে আসিতে তাহার মনে ধারণা হইল যে, ম্যাজিস্ট্রেট যে তাহার সহিত দেখা করিতে আসিয়াছিল সে কথাটা কেবল রাগ করিয়া সে অস্বীকার করিল। মনে মনে কহিলেন, ‘ধরণী দ্বিধা হও !” কিন্তু ধরণী, তাহার অনুরোধ রক্ষা না করাতে নির্বিয়ে বাড়ি আসিয়া পৌঁছিলেন । লাবণ্যকে আসিয়া কহিলেন, “দেশে পাঠাইবার জন্য গোলাপজল কিনিতে গিয়াছিলাম।” বলিতে-নো-বলিতে কালেক্টরের চাপরাস-পরা জনছয়েক পেয়াদা আসিয়া উপস্থিত । সেলাম করিয়া হাস্যমুখে নীরবে দাড়াইয়া রহিল। লাবণ্য হাসিয়া কহিল, “তুমি কনগ্রেসে চান্দা দিয়াছ বলিয়া তোমাকে গ্রেফতার করিতে আসে নাই (AV ?” পেয়াদারা ছয়জনে বারো পাটি দম্ভাগ্রভাগ উন্মুক্ত করিয়া কহিল, “বকশিশ, বাবু সাহেব ।” নীলরতন পাশের ঘর হইতে বাহির হইয়া বিরক্তস্বরে কহিলেন, “কিসের বকশিশ ।”