পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪০৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

se €ዕbrሕ চারু ঘরে ঢুকিয়া বলিল, “এখনো বুঝি তোমার কাজ শেষ হল না। দিনরাত ঐ একখানা কাগজ নিয়ে যে তোমার কী করে কাটে, আমি তাই ভাবি ।” ভূপতি হিসাব সরাইয়া রাখিয়া একটুখানি হাসিল । মনে মনে ভাবিল, “বান্তবিক চারুর প্রতি আমি মনোযোগ দিবার সময়ই পাই না, বড়ো অন্যায়। ও বেচারার পক্ষে সময় কাটাইবার কিছুই নাই ।” ভূপতি স্নেহপূর্ণদ্বরে কহিল, “আজ যে তোমার পড়া নেই! মাস্টারটি বুঝি পালিয়েছেন ? তোমার পাঠশালার সব উলটাে নিয়ম- ছাত্রীটি পৃথিপত্র নিয়ে প্রস্তুত, মাস্টার পলাতক ! আজিকাল অমল তোমাকে আগেকার মতো নিয়মিত পড়ায় বলে তো বোধ হয় না ।” চারু কহিল, “আমাকে পড়িয়ে অমলের সময় নষ্ট করা কি উচিত । অমলকে তুমি বুঝি একজন HAN SANSG GIGGS CYP3 ?” ভূপতি চারুর কটিদেশ ধরিয়া কাছে টানিয়া কহিল, “এটা কি সামান্য প্রাইভেট টিউটারি হল। তোমার মতো বউঠানকে যদি পড়াতে পেতুম তা হলে--” চারু । ইস ইস, তুমি আর বোলো না । স্বামী হয়েই রক্ষে নেই তো আরো কিছু ! ভূপতি ঈষৎ একটু আহত হইয়া কহিল, “আচ্ছা, কাল থেকে আমি নিশ্চয় তোমাকে পড়ব । তোমার বইগুলো আনো দেখি, কী তুমি পড় একবার দেখে নিই।” চারু । ঢের হয়েছে, তোমার আর পড়াতে হবে না । এখনকার মতো তোমার খবরের কাগজের হিসাবটা একটু রাখবে ! এখন আর-কোনো দিকে মন দিতে পারবে কি না বলে । ভূপতি কহিল, “নিশ্চয় পারব। এখন তুমি আমার মনকে যে দিকে ফেরাতে চাও সেই দিকেই ফিরবে ।” চারু । আচ্ছা বেশ, তা হলে আমলের এই লেখাটা একবার পড়ে দেখো কেমন চমৎকার হয়েছে । সম্পাদক অমলকে লিখেছে, এই লেখা পড়ে নবগোপালবাবু তাকে বাংলার রাস্কিন নাম দিয়েছেন । শুনিয়া ভূপতি কিছু সংকুচিতভাবে কাগজখানা হাতে করিয়া লইল । খুলিয়া দেখিল, লেখাটির নাম ‘আষাঢ়ের চাদ' । গত দুই সপ্তাহ ধরিয়া ভূপতি ভারত গবর্মেন্টের বাজেট-সমালোচনা লইয়া বড়ো বডো অঙ্কপাত করিতেছিল, সেই-সকল অঙ্ক বহুপদ কীটের মতো তাহার মন্তিকের নানা বিবরের মধ্যে সঞ্চারণ করিয়া ফিরিতেছিল- এমন সময় হঠাৎ বাংলা ভাষায় ‘আষাঢ়ের চাদ’ প্ৰবন্ধ আগাগোড়া পডিবার জন্য তাহার মন প্ৰস্তুত ছিল না । প্ৰবন্ধটিও নিতান্ত ছোটো নহে । লেখাটা এইরূপে শুরু হইয়াছে- “আজ কেন আষাঢ়ের চাদ সারা রাত মেঘের মধ্যে এমন করিয়া লুকাইয়া বেড়াইতেছে । যেন স্বৰ্গলোক হইতে সে কী চুরি করিয়া আনিয়াছে, যেন তাহার কলঙ্ক ঢাকিবার স্থান নাই । ফাল্গুন মাসে যখন আকাশের একটি কোণেও মুষ্টিপরিমাণ মেঘ ছিল না। তখন তো জগতের চক্ষের সম্মুখে সে নির্লজের মতো উন্মুক্ত আকাশে আপনাকে প্রকাশ করিয়াছিল- আর আজ তাহার সেই ঢলঢল হাসিখানি- শিশুর স্বপ্নের মতো, প্রিয়ার স্মৃতির মতো, সুরেশ্বরী শচীর অলংকবিলম্বিত মুক্তার মালার মতো-" ভূপতি মাথা চুলকাইয়া কহিল, “বেশ লিখেছে। কিন্তু আমাকে কেন । এ-সব কবিত্ব কি আমি বুঝি ।” চারু সংকৃচিত হইয়া ভূপতির হাত হইতে কাগজখানা কড়িয়া লইয়া কহিল,"তুমি তবে কী বোঝ!” ভূপতি কহিল, “আমি সংসারের লোক, আমি মানুষ বুঝি ।” চারু কহিল, “মানুষের কথা বুঝি সাহিত্যের মধ্যে লেখে না ?” ভূপতি । ভুল লেখে। তা ছাড়া মানুষ যখন সশরীরে বর্তমান তখন বানানো কথার মধ্যে তাকে খুঁজে বেড়াবার দরকার ? বলিয়া চারুলতার চিবুক ধরিয়া কহিল, “এই যেমন আমি তোমাকে বুঝি, কিন্তু সেজন্য কি ‘মেঘনাদবধ কবিকঙ্কণ চণ্ডী” আগাগোড়া পড়ার দরকার আছে ।” ভূপতি কাব্য বোঝে না বলিয়া অহংকার করিত । তবু অমলের লেখা ভালো করিয়া না পড়িয়াও