পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৭৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8(ሎbr রবীন্দ্র-রচনাবলী সম্বন্ধে হিসাবের এমনি কষাকষি যে পাড়ার ফুটবল ক্লাবের নাছোড়বান্দা ছেলেরাও বহু চেষ্টায় তাহার তহবিলে দন্তস্ফুট করিতে পারে নাই। এমন সময় তাহার ঘরকন্নার মধ্যে একটি অতিথির আগমন হইল । ছেলে হল না, হল না, করিতে করিতে অনেকদিন পরে তাহার একটি ছেলে জন্মিল । ছেলেটির চেহারা তাহার মার ধরনের । বড়ো বড়ো চোখ, টিকলো নাক, রঙ রজনীগন্ধর পাপড়ির মতো— যে দেখিল সেই বলিল, “আহা ছেলে তো নয়, যেন কাৰ্তিক ।” অধরবাবুর অনুগত অনুচর রীতিকান্ত বলিল, “বড়ো ঘরের ছেলের যেমনটি হওয়া উচিত তেমনই হইয়াছে।” ছেলেটির নাম হইল বেণুগোপাল । ইতিপূর্বে অধরবাবুর স্ত্রী ননীবালা সংসারখরচ লইয়া স্বামীর বিরুদ্ধে নিজের মত তেমন জোর করিয়া কোনোদিন খাটান নাই । দুটাে একটা শখের ব্যাপার অথবা লৌকিকতার অত্যাবশ্যক আয়োজন লইয়া মাঝে মাঝে বচসা হইয়াছে বটে, কিন্তু শেষকালে স্বামীর কৃপণতার প্রতি অবজ্ঞা করিয়া নিঃশব্দে হার মানিয়াছেন । এবারে ননীবালাকে অধরলাল আঁটিয়া উঠিতে পারিলেন না, বেণুগোপাল সম্বন্ধে তাহার হিসাব এক-এক পা করিয়া হঠিতে লাগিল । তাহার পায়ের মল, হাতের বালা, গলার হার, মাথার টুপি, তাহার দিশি বিলাতি নানা রকমের নানা রঙের সাজসজ্জা সম্বন্ধে ননীবালা যাহা-কিছু দাবি উত্থাপিত করিলেন, সব কটাই তিনি কখনো নীরব অশ্রুপাতে, কখনো সরব বাক্যবর্ষণে জিতিয়া লইলেন । বেণুগোপালের জন্য যাহা দরকার এবং যাহা দরকার নয় তাহা চাইই চাই- সেখানে শূন্য তহবিলের ওজর বা ভবিষ্যতের ফাঁকা আশ্বাস একদিনও খাটিল না । বেণুগোপাল বাডিয়া উঠিতে লাগিল । বেণুর জন্য খরচ করাটা অধরলালের অভ্যাস হইয়া আসিল " তাহার জন্য বেশি মাহিনা দিয়া অনেক-পাস-করা এক বুড়ো মাস্টার রাখিলেন । এই মাস্টার বেণুকে মিষ্টভাষায় ও শিষ্টাচারে বশ করিবার অনেক চেষ্টা করিলেন- কিন্তু তিনি নাকি বরাবর ছাত্ৰাদিগকে কড়া শাসনে চালাইয়া আজ পর্যন্ত মাস্টারি মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখিয়া আসিয়াছেন, সেইজনা তাহার ভাষার মিষ্টতা ও আচারের শিষ্টতায় কেবলই বেসুর লাগিল— সেই শুক সাধনায় ছেলে ভুলিল না । ননীবালা অধরলালকে কহিলেন, “ও তোমার কেমন মাস্টার । ওকে দেখিলেই যে ছেলে অস্থির হইয়া উঠে । ওকে ছাড়াইয়া দাও।” স্বয়ম্মাস্টার হইতে বসিল- সে যাহাকে না বরিয়া লইবে তাহার সকল পাস ও সকল সাটিফিকেট বৃথা । এমনি সময়টিতে গায়ে একখানি ময়লা চাদর ও পায়ে ছেড়া ক্যাম্বিসের জুতা পরিয়া মাস্টারির উমেদারিতে হরলাল আসিয়া জুটিল । তাহার বিধবা মা পরের বাড়িতে রাধিয়া ও ধান ভানিয়া তাহাকে মফস্বলের এনট্রেন্স স্কুলে কোনোমতে এনট্রেন্স পাস করাইয়াছে। এখন হরলাল কলিকাতায় কলেজে পড়িবে বলিয়া প্রাণপণ প্রতিজ্ঞা করিয়া বাহির হইয়াছে। অন্যহারে তাহার মুখের নিম্ন অংশ শুকাইয়া ভারতবর্ষের কন্যাকুমারীর মতো সরু হইয়া আসিয়াছে, কেবল মন্ত কপালটা হিমালয়ের মতো প্রশস্ত হইয়া অত্যন্ত চোখে পড়িতেছে। মরুভূমির বালু হইতে সূর্যের আলো যেমন ঠিকারিয়া পড়ে তেমনি তাহার দুই চক্ষু হইতে দৈন্যের একটা অস্বাভাবিক দীপ্তি বাহির হইতেছে। দরোয়ান জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি কী চাও । কাহাকে চাও।” হরলাল ভয়ে ভয়ে বলিল, “বাড়ির বাবুর সঙ্গে দেখা করিতে চাই ।” দরোয়ান কহিল, “দেখা হইবে না ।” তাহার উত্তরে হরলাল কী বলিবে ভাবিয়া না পাইয়া ইতস্তত করিতেছিল, এমন সময় সাত বছরের ছেলে বেণুগোপাল বাগানে খেলা সারিয়া দেউড়িতে আসিয়া উপস্থিত হইল। দরোয়ান হরলালকে দ্বিধা করিতে দেখিয়া আবার কহিল, “বাবু, চলা যাও।”