পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৯৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8brの রবীন্দ্র-রচনাবলী বিশেষ স্থান হইতে পাথর খসাইয়া এক শাখাপথ আবিষ্কার করিলেন । সেই পথে চলিতে চলিতে আবার এক জায়গায় পথ অবরুদ্ধ হইয়া গেল । অবশেষে পঞ্চম রাত্রে সুরঙ্গের মধ্যে প্রবেশ করিয়া সন্ন্যাসী বলিয়া উঠিলেন, “আজি আমি পথ পাইয়াছি, আজ আর আমার কোনোমতেই ভুল হইবে না।” পথ অতান্ত জটিল ; তাহার শাখাপ্রশাখার অন্ত নাই- কোথাও এত সংকীর্ণ যে গুড়ি মারিয়া যাইতে হয় । বহু যত্নে মশাল ধরিয়া চলিতে চলিতে সন্ন্যাসী একটা গোলাকার ঘরের মতো জায়গায় আসিয়া পৌঁছিলেন । সেই ঘরের মাঝখানে একটা বৃহৎ ইন্দারা । মশালের আলোকে সন্ন্যাসী তাহার তল দেখিতে পাইলেন না । ঘরের ছাদ হইতে একটা মোটা প্ৰকাণ্ড লীেহশখাল ইদারার মধ্যে নামিয়া গেছে। সন্ন্যাসী প্ৰাণপণ বলে ঠেলিয়া এই শৃঙ্খলটাকে অল্প একটুখানি নাড়াইবামাত্র ঠং করিয়া একটা শব্দ ইদারার গহবর হইতে উথিত হইয়া ঘরাময় প্ৰতিধ্বনিত হইতে লাগিল । সন্ন্যাসী উচ্চৈঃস্বরে বলিয়া উঠিলেন, “পাইয়াছি।” 峰 যেমন বলা আমনি সেই ঘরের ভাঙা ভিত্তি হইতে একটা পাথর গড়াইয়া পড়িল, আর সেইসঙ্গে আর-একটি কী সচেতন পদার্থ ধাপ করিয়া পড়িয়া চিৎকার করিয়া উঠিল । সন্ন্যাসী এই অকস্মাৎ শব্দে চমকিয়া উঠিতেই তাহার হাত হইতে মশাল পডিয়া নিবিয়া গেল । Q সন্ন্যাসী জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি কে ।” কোনো উত্তর পাইলেন না । তখন অন্ধকারে হাতড়াইতে গিয়া তাহার হাতে একটি মানুষের দেহ ঠেকিল । তাহাকে নাড়া দিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কে তুমি ।” কোনো উত্তর পাইলেন না । লোকটা অচেতন হইয়া গেছে । তখন চকমকি ঠকিয় ?কিয়া সন্ন্যাসী অনেক কষ্ট্রে মশাল ধরাইলেন । ইতিমধ্যে সেই লোকটাও সংজ্ঞাপ্ৰাপ্ত হইল, আর উঠিবার চেষ্টা করিয়া বেদনায় আর্তনাদ করিয়া উঠিল । সন্ন্যাসী কহিলেন, “এ কী, মৃত্যুঞ্জয় যে ! তোমার এ মতি হইল কেন ।” মৃত্যুঞ্জয় কহিল, “বাবা, মপি করে । ভগবান আমাকে শান্তি দিয়াছেন । তোমাকে পাথর ছুড়িয়া মারিতে গিয়া সামলাইতে পারি নাই- পিছলে পাথর সুদ্ধ আমি পড়িয়া গেছি। পা-টা নিশ্চয় ভাঙিয়া গেছে ।” সন্ন্যাসী কহিলেন, “আমাকে মারিয়া তোমার কী লাভ হইত ।” মৃত্যুঞ্জয় কহিল, “লাভের কথা তুমি জিজ্ঞাসা করিতেছি ! তুমি কিসের লোভে আমার পূজাঘর হইতে লিখনখানি চুরি করিয়া এই সুরঙ্গের মধ্যে ঘুরিয়া বেড়াইতেছ। তুমি চোর, তুমি ভণ্ড ! আমার পিতামহকে যে সন্ন্যাসী ঐ লিখন খানি দিয়াছিলেন তিনি বলিয়াছিলেন, আমাদেরই বংশের কেহ এই লিখনের সংকেত বুঝিতে পরিবে । এই গুপ্ত ঐশ্বৰ্য আমাদেরই বংশের প্রাপ্য। তাই আমি এ কয়দিন না খাইয়া না ঘুমাইয়া ছায়ার মতো তোমার পশ্চাতে ফিরিয়াছি। আজ যখন তুমি ৱিলিয়া উঠিলে “পাইয়াছি তখন আমি আর থাকিতে পারিলাম না । আমি তোমার পশ্চাতে আসিয়া ঐ গর্তটার ভিতরে লুকাইয়া বসিয়া ছিলাম। ওখান হইতে একটা পাথর খসাইয়া তোমাকে মারিতে গেলাম, কিন্তু শরীর দুর্বল, জায়গাটাও অত্যন্ত পিছিল- তাই পড়িয়া গেছি। এখন তুমি আমাকে মারিয়া ফেলো সেও ভালো- আমি যক্ষ হইয়া এই ধন আগলাইব- কিন্তু তুমি ইহা লইতে পরিবে না, কোনোমতেই না । যদি লইতে চেষ্টা কর, আমি ব্ৰাহ্মণ, তোমাকে অভিশাপ দিয়া এই কৃপের মধ্যে ঝাপ দিয়া পড়িয়া আত্মহত্যা করিব । এ ধন তোমার ব্ৰহ্মরক্ত গোরক্ততুল্য হইবে- এ ধন তুমি কোনোদিন সুখে ভোগ করিতে পরিবে না । আমাদের পিতা পিতামহ এই ধনের উপরে সমন্ত মন রাখিয়া মরিয়াছেন- এই ধনের ধ্যান করিতে করিতে আমরা দরিদ্র হইয়াছি- এই ধনের সন্ধানে আমি বাড়িতে অনাথ স্ত্রী ও শিশুসন্তান ফেলিয়া আহারনিদ্রা ছাড়িয়া লক্ষ্মীছাড়া পাগলের মতো মাঠে ঘাটে ঘুরিয়া বেড়াইতেছি।- এ ধন তুমি আমার চোখের সম্মুখে কখনো লইতে পরিবে না ।”