পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫১১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

888 রবীন্দ্র-রচনাবলী আজ সম্পূর্ণই বিড়ালের ভোগে লাগিবে। . তখন দড়ি দিয়া মোড়া কাগজের এক বাক্স লইয়া রাসমণি তঁহার স্বামীর সম্মুখে আনিয়া উপস্থিত করিলেন । আহারের পরে যখন ভবানীচরণ বিশ্রাম করিতে যাইবেন তখনই এই রহস্যটা তিনি আবিষ্কার করিকেন ইহাই রাসমণির ইচ্ছা ছিল, কিন্তু দধি পায়স ও মাছের মুড়ার অনাদর দূর করিবার জন্য এখনই এটা বাহির করিতে হইল। বাক্সের ভিতর হইতে সেই মোমমূর্তি বাহির হইয়া বিনা বিলম্বে প্ৰবল উৎসাহে আপন গ্ৰীষ্মতাপ-নিবারণে লাগিয়া গেল। বিড়ালকে আজ হতাশ হইয়া ফিরিতে হইল । ভবানীচরণ গৃহিনীকে বলিলেন, “আজ রান্নাটা বড়ো উত্তম হইয়াছে। অনেকদিন এমন মাছের ঝোল থাই নাই । আর দইটা যে কী চমৎকার জমিয়াছে সে আর কী বলিব ।” সপ্তমীর দিন কালীপদ তাহার অনেক দিনের আকাঙক্ষার ধন পাইল । সেদিন সমান্ত দিন সে মেমের পাখা খাওয়া দেখিল, তাহার সমবয়সী বন্ধুবান্ধবদিগকে দেখাইয়া তাহদের ঈর্ষার উদ্রেক করিল। অন্য কোনো অবস্থায় হইলে সমস্তক্ষণ এই পুতুলের একঘেয়ে পাখা নাড়ায় সে নিশ্চয়ই একদিনেই বিরক্ত হইয়া যাইত- কিন্তু অষ্টমীর দিনেই এই প্রতিমা বিসর্জন দিতে হইবে জানিয়া তাহার অনুরাগ অটল হইয়া রহিল। রাসমণি তঁহার গুরুপুত্রকে দুই টাকা নগদ দিয়া কেবল একদিনের জন্য এই পুতুলটি ভাড়া করিয়া আনিয়াছিলেন। অষ্টমীর দিনে কালীপদ দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া স্বহন্তে বাক্সসমেত পুতুলটি বগলাচরণের কাছে ফিরাইয়া দিয়া আসিল । এই একদিনের মিলনের সুখসমৃতি অনেকদিন তাহার মনে জাগরকে হইয়া রহিল ; তাহার কল্পনালোকে পাখা চলার আর বিরাম রহিল না । এখন হইতে কালীপদ মাতার মন্ত্রণার সঙ্গী হইয়া উঠিল এবং এখন হইতে ভবানীচরণ প্রতিবৎসরই এত সহজে এমন মূল্যবান পূজার উপহার কালীপদকে দিতে পারিতেন যে, তিনি নিজেই আশ্চর্য হইয়া যাইতেন । পৃথিবীতে মূল্য না দিয়া যে কিছুই পাওয়া যায় না এবং সে মূল্য যে দুঃখের মূল্য, মাতার অন্তরঙ্গ হইয়া সে কথা কালীপদ প্রতিদিন যতই বুঝিতে পারিল ততই দেখিতে দেখিতে সে যেন ভিতরের দিক হইতে বড়ো হইয়া উঠিতে লাগিল । সকল কাজেই এখন সে তার মাতার দক্ষিণপাৰ্থে আসিয়া দাড়াইল । সংসারের ভার বহিতে হইবে, সংসারের ভার বাড়াইতে হইবে না, এ কথা বিনা উপদেশবাক্যেই তাহার রক্তের সঙ্গেই মিশিয়া গেল । জীবনের দায়িত্ব গ্ৰহণ করিবার জন্য তাহাকে প্ৰস্তুত হইতে হইবে, এই কথা স্মরণ রাখিয়া কালীপদ প্ৰাণপণে পড়িতে লাগিল । ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া যখন সে ছাত্রবৃত্তি পাইল তখন ভবানীচরণ মনে করিলেন, আর বেশি পড়াশুনার দরকার নাই, এখন কালীপদ ঠাহীদের বিষয়কর্ম দেখায় প্ৰবৃত্ত হউক । কালীপদ মাকে আসিয়া কহিল, “কলিকাতায় গিয়া পড়াশুনা না করিতে পারিলে আমি তো মানুষ श्ड eादि ना ।” মা বলিলেন, “সে তো ঠিক কথা বাবা, কলিকাতায় তো যাইতেই হইবে।” কালীপদ কহিল, “আমার জন্যে কোনো খরচ করিতে হইবে না। এই বৃত্তি হইতেই চালাইয়া দিবএবং কিছু কাজকর্মেরও জোগাড় করিয়া লইব ।” ভবানীচরণকে রাজি করাইতে অনেক কষ্ট পাইতে হইল। দেখিবার মতো বিষয়সম্পত্তি যে কিছুই নাই সে কথা বলিলে ভবানীচরণ অত্যন্ত দুঃখ বোধ করেন। তাই রাসমণিকে সে যুক্তিটা চাপিয়া যাইতে হইল। তিনি বলিলেন, “কালীপদকে তো মানুষ হুহঁতে হইবে।” কিন্তু পুরুষানুক্ৰমে কোনোদিন শানিয়াড়ির বাহিরে না গিয়াই তো চৌধুরীরা এতকাল মানুষ হইয়াছে। বিদেশকে তাহারা যমপুরীর মতো ভয় করেন । কালীপদর মতো বালককে একলা কলিকাতায় পাঠাইবার প্রস্তাবমাত্র কী করিয়া কাহারও মাথায় আসিতে পারে তিনি ভাবিয়া পাইলেন না। অবশেষে গ্রামের সর্বপ্রধান বুদ্ধিমান ব্যক্তি বগলাচরণ পর্যন্ত রাসমণির মতে মত দিল। সে বলিল, “কালীপদ একৃঢ়িন উকিল হইয়া সেই উইল-চুরি ফকির শোধ দিবে, নিশ্চয়ই এ তাহার ভাগ্যের লিখন- অতএব কলিকাতায় যাওয়া হইতে