পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫২৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

४०० • রবীন্দ্র-রচনাবলী গোপাল যেন অন্য ছেলেদের চেয়ে রসিকের কাছে কিছু বেশি প্রশ্ৰয় পাইত । বংশী মনে মনে ঠিক করিল, এই সীেরভীর সঙ্গেই রসিকের বিবাহ দিতে হইবে । কিন্তু সীেরভীর ঘর তাহদের চেয়ে বড়ো- পাঁচশো টাকার কমে কাজ হইবার আশা নাই । NR এতদিন বংশী কখনো রসিককে তাহার। তাতবোনায় সাহায্য করিতে অনুরোধ করে নাই । খাটনি সমস্তই সে নিজের ঘাড়ে লইয়াছিল । রসিক নানাপ্রকার বাজে কাজ লইয়া লোকের মনোরঞ্জন করিত ইহা তাহার দেখিতে ভালোই লাগিত । রসিক ভাবিত, ‘দাদা কেমন করিয়া যে রোজই এই এক ঠাতের কাজ লইয়া পড়িয়া থাকে কে জানে। আমি হইলে তো মরিয়া গেলেও পারি না ।” তাহার দাদা নিজের সম্বন্ধে নিতান্তই টানাটানি করিয়া চালাইত, ইহাতে সে দাদাকে কৃপণ বলিয়া জানিত । তাহার দাদার সম্বন্ধে রসিকের মনে যথেষ্ট একটা লজ্জা ছিল । শিশুক্লাল হইতেই সে নিজেকে তাহার দাদা হইতে সকল বিষয়ে ভিন্ন শ্রেণীর লোক বলিয়াই জানিত । তাহার দাদাই তোহার এই ধারণাকে প্রশ্ৰয় দিয়া আসিয়াছে । এমন সময়ে বংশী নিজের বিবাহের আশা বিসর্জন দিয়া রসিকেরই বধু আনিবার জন্য যখন উৎসুক হইল তখন বংশীর মন আর ধৈর্য মানিতে চাহিল না । প্ৰত্যেক মাসের বিলম্ব তাহার কাছে অসহ্য বোধ হইতে লাগিল । বাজনা বাজিতেছে, আলো জ্বালা হইয়াছে, বরসজা করিয়া রসিকের বিবাহ হইতেছে, এই আনন্দের ছবি বংশীর মনে তৃষ্ণার্তের সম্মুখে মৃগতৃফিকার মতো কেবলই জাগিয়া আছে। তবু যথেষ্ট দ্রুতবেগে টাকা জমিতে চায় না। যত বেশি চেষ্টা করে ততই যেন সফলতাকে আরো বেশি দূরবতী বলিয়া মনে হয় ; বিশেষত মনের ইচ্ছার সঙ্গে শরীরটা সমান বেগে চলিতে চায় না, বার বারা ভাঙিয়া ভাঙিয়া পড়ে । পরিশ্রমের মাত্রা দেহের শক্তিকে ছাড়াইয়া যাইবার জো করিয়াছে। যখন সমস্ত গ্রাম নিযুপ্ত, কেবল নিশা-নিশাচরীর চৌকিদারের মতো প্রহরে প্রহরে শৃগালের দল হাক দিয়া যাইতেছে, তখনো মিটমিটে প্রদীপে বংশী কাজ করিতেছে, এমন কত রাত ঘটিয়াছে। বাড়িতে তাহার এমন কেহই ছিল না যে তাহাকে নিষেধ করে। এ দিকে যথেষ্ট পরিমাণে পুষ্টিকর আহার হইতেও বংশী নিজেকে বঞ্চিত করিয়াছে। গায়ের শীতবস্ত্ৰখানা জীৰ্ণ হইয়া পড়িয়াছে, তাহা নানা ছিদ্রের খিড়কির পথ দিয়া গোপনে শীতকে ডাকিয়া-ডাকিয়াই আনে। গত দুই বৎসর হইতে প্ৰত্যেক শীতের সময় বংশী মনে করে, “এইবারটা একরকম করিয়া চালাইয়া দি, আর একটু হাতে টাকা জমুক, আসছে। বছরে যখন কাবুলিওয়ালা তাহার শীতবস্ত্রের বোঝা লইয়া গ্রামে আসিবে তখন একটা কাপড় ধারে কিনিয়া তাহার পরের বৎসরে শোধ করিব, ততদিনে তহবিল ভরিয়া উঠিবে।' সুবিধামত বৎসর আসিল না । ইতিমধ্যে তাহার শরীর টেকে না এমন হইয়া আসিল । এতদিন পরে বংশী তাহার ভাইকে বলিল, “ষ্ঠাতের কাজ আমি একলা চালাইয়া উঠিতে পারি না, তুমি আমার কাজে যোগ দাও।” রসিক কোনো জবাব না করিয়া মুখ বাকাইল। শরীরের অসুখে বংশীর মেজাজ খারাপ ছিল, সে রসিককে ভৎসনা করিল ; কহিল, “বাপ-পিতামহের ব্যাবসা পরিত্যাগ করিয়া তুমি যদি দিনরাত হাে হাে করিয়া বেড়াইবে তবে তোমার দশা হইবে কী ।” কথাটা অসংগত নহে এবং ইহাকে কটুক্তিও বলা যায় না । কিন্তু রসিকের মনে হইল এতবড়ো অন্যায় তাহার জীবনে সে কোনোদিন সহ্য করে নাই। সেদিন বাড়িতে সে বড়ো একটা কিছু খাইল না ; হিপ হাতে করিয়া চন্দনীন্দহে মাছ ধরিতে বসিল । শীতের মধ্যাহ্ন নিন্তব্ধ, ভাঙা উচু পাড়ির উপর শালিক নাচিতেছে, পশ্চাতের আমবাগানে ঘুঘু ডাকিতেছে এবং জলের কিনারায় শৈবালের উপর একটি পতঙ্গ তাহার স্বচ্ছ দীর্ঘ দুই পাখা মেলিয়া দিয়া স্থিরভাবে রৌদ্র পোহাইতেছে। কথা ছিল রসিক আজ গোপালকে লাঠিখেলা শিখাইবে- গোপাল তাহার আশু কোনো সম্ভাবনা না দেখিয়া রসিককে উড়ের মধ্যেকার মাছ ধরিবার কেঁচোগুলোকে লইয়া অস্থিরভাবে ঘাটাঘাটি করিতে লাগিল- রসিক