পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৪৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পারস্যে Vec) বাহ্যিক সব রকম কল পুরোদমে চলে। আমাদের দেশে সেই অল্পের চিন্তা ব্যক্তিগত, সে চিন্তার শুধু যে জোর নেই তা নয়, সে বাধাগ্রান্ত । ওদের দেশে সে চিন্তা রাষ্টগত, সে দিকে সমস্ত জাতির সাধনার পথ স্বাধীনভাবে উন্মুক্ত, এমন-কি, নিষ্ঠুর অন্যায়ের সাহায্য নিতেও দ্বিধা নেই। ভারতের ভাগ্যনিয়ন্তার দৃষ্টি হতে আমরা বহু দূরে, তাই আমাদের পক্ষে শাসন যত অজস্র সুলভ অশন তত নয় । R মহামানব জাগেন যুগে যুগে ঠাই বদল করে। একদা সেই জাগ্ৰত দেবতার লীলাক্ষেত্র বহু শতাব্দী ধরে এশিয়ায় ছিল । তখন এখানেই ঘটেছে মানুষের নব নব ঐশ্বর্যের প্রকাশ নব নব শক্তির পথ দিয়ে । আজ সেই মহামানবের উজ্বল পরিচয় পাশ্চাত্য মহাদেশে । আমরা অনেক সময় তাকে জড়বাদপ্রধান বলে খর্ব করবার চেষ্টা করি । কিন্তু কোনো জাত মহত্ত্বে পৌঁছতেই পারে না একমাত্র জড়বাদের ভেলায় চড়ে । বিশুদ্ধ জড়বাদী হচ্ছে বিশুদ্ধ বর্বর । সেই মানুষই বৈজ্ঞানিক সত্যকে লাভ করবার অধিকারী সত্যকে যে শ্রদ্ধা করে পূর্ণ মূল্য দিতে পারে। এই শ্রদ্ধা আধ্যাত্মিক, প্ৰাণপণ নিষ্ঠায় সত্যসাধনার শক্তি আধ্যাত্মিক । পাশ্চাত্য জাতি সেই মোহমুক্ত আধ্যাত্মিক শক্তি-দ্বারাই সত্যকে জয় করেছে এবং সেই শক্তিই জয়ী করেছে তাদের । পৃথিবীর মধ্যে পাশ্চাত্য মহাদেশেই মানুষ আজ উজ্বল তেজে প্ৰকাশমান । সচল প্ৰাণের শক্তি যত দুর্বল হয়ে আসে দেহের জড়ত্ব ততই নানা আকারে উৎকট হয়ে ওঠে । একদিন ধর্মে কর্মে জ্ঞানে এশিয়ার চিত্ত প্ৰাণবান ছিল, সেই প্ৰাণধর্মের প্রভাবে তার আত্মসৃষ্টি বিচিত্র হয়ে উঠত । তার শক্তি যখন ক্লান্ত ও সুপ্তিময় হল, তার সৃষ্টির কাজ যখন হল বন্ধ, তখন তার ধর্মকর্ম অভ্যন্ত আচারের যন্ত্রবৎ পুনরাবৃত্তিতে নিরর্থক হয়ে উঠল । একেই বলে জড়তত্ত্ব, এতেই মানুষের সকল দিকে পরাভব ঘটায় । অপরপক্ষে পাশ্চাত্য জাতির মধ্যে বিপদের লক্ষণ আজ যা দেখা দিয়েছে সেও একই কারণে । বৈজ্ঞানিক বুদ্ধি ও শক্তি তাকে প্রভাবশালী করেছে, এই প্রভাব সত্যের বরদান । কিন্তু সত্যের সঙ্গে মানুষের ব্যবহার কলুষিত হলেই সত্য তাকে ফিরে মারে । বিজ্ঞানকে দিনে দিনে য়ুরোপ আপন লোভের বাহন করে লাগামে বাধছে । তাতে করে লোভের শক্তি হয়ে উঠছে প্ৰচণ্ড, তার আকার হয়ে উঠছে বিরাট । যে ঈর্ষা হিংসা মিথ্যাচারকে সে বিশ্বব্যাপী করে তুলছে তাতে করে যুরোপের রাষ্ট্রসত্তা আজ বিষজীৰ্ণ । প্রবৃত্তির প্রাবল্যও মানুষের জড়িত্বের লক্ষণ । তার বুদ্ধি তার ইচ্ছা তখন কলের পুতুলের মতো চালিত হয় । এতেই মনুষ্যত্বের বিনাশ । এর কারণ যন্ত্র নয়, এর কারণ আন্তরিক তামসিকতা, লোভ হিংসা পশুবৃত্তি । বাঁধনখোলা উন্মত্ত যখন আত্মঘাত করে তখন মুক্তিই তার কারণ नग्र, उाल काs भखठा । বয়স যখন অল্প ছিল তখন যুরোপীয় সাহিত্য গভীর আনন্দের সঙ্গে পড়েছি, বিজ্ঞানের বিশুদ্ধ সত্য আলোচনা করে তার সাধকের পরে ভক্তি হয়েছে মনে । এর ভিতর দিয়ে মানুষের যে পরিচয় আজ চারি দিকে ব্যাপ্ত হয়েছে তার মধ্যেই তো শাশ্বত মানুষের প্রকাশ ; এই প্ৰকাশকে লোভান্ধ মানুষ অবমানিত করতে পারে । সেই পাপে হীনমতি নিজেকেই সে নষ্ট করবে। কিন্তু মহৎকে নষ্ট করতে পারবে না। সেই মহৎ, সেই জাগ্ৰত মানুষকে দেখব বলেই একদিন ঘরের থেকে দূরে বেরিয়েছিলুম, যুরোপে গিয়েছিলুম। ১৯১২ খৃস্টাব্দে । এই যাত্রাকে শুভ বলেই গণ্য করি । কেননা, আমরা এশিয়ার লোক, যুরোপের বিরুদ্ধে নালিশ আমাদের রক্তে । যখন থেকে তাদের জলদস্য ও স্থলদস্য দুর্বল মহাদেশের রক্ত শোষণ করতে বেরিয়েছে সেই আঠারো শতাব্দী থেকে আমাদের কাছে এরা নিজেদের মানহানি করেছে। লজা নেই, কেননা, এরা আমাদের লজ্জা করবার যোগ্য বলেও মনে করে নি। কিন্তু যুরোপে এসে একটা কথা আমি প্ৰথম আবিষ্কার করলুম যে, সহজ মানুষ আর নেশন এক জাতের লোক নয়। যেমন সহজ