পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৮১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VVS রবীন্দ্র-রচনাবলী করে বন্দী করেন। প্রতিমূর্তিতে ভূমিশায়ী সেই মূর্তির বুকে দরিয়ুসের পা, বন্দী উঞ্চের্য দুই হাত তুলে ক্ষমা ভিক্ষা করছে। দরিয়ুসের মাথার উপরে অহুরমজদার মূৰ্তি । অধ্যাপক হর্টজফেলড বলেন, সম্প্রতি একটি শিলালিপি বেরিয়েছে তাতে দরিয়ুস জানাচ্ছেন, তিনি যখন সিংহাসনে বসেন তখন তার পিতা পিতামহ উভয়েই বর্তমান । এই প্ৰথাবিরুদ্ধ ব্যাপার কী করে সম্ভব হল তার কোনো বিবরণ পাওয়া যায় না । সমুদ্রের মাঝে মাঝে এক-একটা দ্বীপ দেখা যায় যা ভূমিকম্পের হাতে তৈরি । তার সর্বত্র গলিত ধাতু আর অগ্নিস্রাবের চিহ্ন । তেমনি বহুযুগ ধরে ইতিহাসের ভূমিকম্পে এবং অগ্নি-উদগীরণে পারস্যের জন্ম। প্রাচীনকাল থেকে পারস্যে সাম্রাজা সৃষ্টি হয়ে এসেছে। মানুষের ইতিহাসে সব চেয়ে পুরাতন মহাসাম্রাজ্য সাইরাস স্থাপন করেন, তার পরেও দীর্ঘকাল পারসোর ইতিহাসক্ষেত্রে সাম্রাজ্যিক দ্বন্দ্ব | তার প্রধান কারণ, পারস্যের চারি দিকেই বড়ো বড়ো প্রাচীন রাজশক্তির স্থান । হয় তাদের সকলকে দমন করে রাখতে হবে, নয় তাদের কেউ-না-কেউ এসে পারস্যকে গ্ৰাস করবে । নানা জাতির সঙ্গে এই নিরন্তর দ্বন্দ্ব থেকেই পারস্যের ঐতিহাসিক বোধ, ঐতিহাসিক সত্তা এত প্ৰবল হয়ে উঠেছে । ভারতবর্ষ সমাজ সৃষ্টি করেছে, মহাজাতির ইতিহাস সৃষ্টি করে নি । আর্যের সঙ্গে অনার্যের দ্বন্দ্ব প্রধানত সামাজিক । অপেক্ষাকৃত অল্পসংখ্যক আৰ্য বহুসংখ্যক অনার্যের মাঝখানে পড়ে নিজের সমাজকে বাচাতে চেয়েছিলেন । রামের সঙ্গে রাবণের যুদ্ধ রাষ্ট্রজয়ের নয়, সমাজরক্ষার- সীতা সেই সমাজনীতির প্রতীক ? রাবণ সীতাহরণ করেছিল, রাজাহবণ করে নি । মহাভারতেও বস্তুত সমাজনীতির দ্বন্দ্ব, এক পক্ষ কৃষ্ণকে স্বীকার করেছে, কৃষ্ণাকে পণ রেখে তাদের পাশা খেলা, অনা পক্ষ কৃষ্ণকে অস্বীকার ও কৃষ্ণাকে করেছে অপমান । শাহনামায় আছে প্ৰকৃত ইতিহাসের কথা, রাষ্ট্রীয় বীরদের কাহিনী, ইরানীদের সঙ্গে তাতারীদের বিবোধ ! তাতে ভগবদগীতার মতো তত্ত্বকথা বা গান্তিপর্বের মতো নীতি-উপদেশ প্রাধান্য পায় নি । পারস্য বার বার পরজাতির বিরুদ্ধে দাড়িয়ে আপন পারসিক ঐক্যাকে দৃঢ় করবার ও জয়ী করবার চষ্টা করেছে । গুপ্তরাজাদের আমলে ভারতবর্ষ একবার আপনি সাম্রাজ্যিক একসত্তা অনুভব করবার যোগ পেয়েছিল, কিন্তু তার প্রভাব গভীর ও স্থায়ী হয় নি । তার প্রধান কারণ, ভারতবর্ষ অন্তরে যন্তরে আর্যে অনার্যে বিভক্ত, সাম্রাজ্যিক ঐক্য সামাজিক ঐক্যের উপর ভিত পাততে পারে নি । রিয়ুস শিলাবক্ষে এমনভাবে আপন জয়ঘোষণা করেছেন যাতে চিরকাল তা স্থায়ী হয় । কিন্তু এই য়েঘোষণা প্রকৃতপক্ষে ঐতিহাসিক, দরিয়ুস পারসিক রাষ্ট্রসত্তার জন্যে বৃহৎ আসন রচনা করেছিলেন ; যমন সাইরাসকে তেমনি দরিয়ুসকে অবলম্বন করে পারস্য আপন অখণ্ড মহিমা বিরাট ভূমিকায় নুভব করতে পেরেছিল। পারস্যে পর্বে পর্বে এই রাষ্টিক উপলব্ধি পরাভবকে অতিক্রম করে জগেছে, আজও আবার তার জাগরণ হল । এখানকার প্রধানমন্ত্রী আমাকে যা বলেছিলেন তার মূল থাটা হচ্ছে এই যে, আপনি সমাজনিহিত দুর্বলতার কারণ দূর করাই ভারতবর্ষের সমস্যা, আর রিস্যের সমস্যা আপন শাসনব্যবস্থার অপূর্ণতা মোচন করা । পারস্য সেই কাজে লেগেছে, ভারতবর্ষ খনো আপনার যথার্থ কাজে সম্পূৰ্ণ শ্রদ্ধা ও নিষ্ঠার সঙ্গে লাগে নি । বেহিস্তান থেকে কেরলাম। অদূরে তাকিবুস্তানের পাহাড়ে উৎকীর্ণ মূর্তি । শহর থেকে মাইল-চারেক র। গবর্নরের দৃত এসে পথের মধ্যে থেকে সেখানে আমাদের নিয়ে গেলেন । দূরে থেকেই দেখা য় অগভীর গুহাগাত্রে খোদাই-করা মূর্তি, তার সামনে কৃত্ৰিম সরোবরে ঝরে পড়ছে জলস্রোত । দুটি তঁ দাড়িয়ে, পায়ের তলায় দলিত একজন বন্দী । কোনো লেখা পাওয়া যায় না, কিন্তু সাজসজায় ঝা যায়। এরা সাসানীয়। পাহাড়ের মধ্যে খোদাই করে তোলা একটি গম্বুজাকৃতি কক্ষের উধ্বভাগে হাতে অভিষেকের পাত্র ও ডান হাতে মালা নিয়ে পাখা মেলে বিজয়দেবতা দাড়িয়ে, তার নীচে ঠ দাড়ানো মূর্তি এবং তার নীচে বর্মপরা অশ্বারোহী । পাশের দেয়ালে শিকারের ছবি । এই ঠগুলিতে আশ্চর্য একটি শক্তি প্ৰকাশ পেয়েছে দেখে মন স্তজিত হয় । সাসানীয় যুগ বলতে কী বোঝায় সংক্ষেপে বলে রাখি ।