পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৪১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8७० রবীন্দ্র-রচনাবলী অধিক কৌশল করিতে হইল না। জগমোহন আদালতে স্পষ্টই কবুল করিলেন, তিনি দেবদেবী মানেন না ; খাদ্য-অখাদ্য বিচার করেন না ; মুসলমান ব্ৰহ্মার কোনখান হইতে জমিয়াছে তাহা তিনি জানেন না এবং তাহদের সঙ্গে তার খাওয়াদাওয়া চলার কোনো বাধা নাই । মুনসেফ জগমোহনকে সেবায়েত-পদের অযোগ্য বলিয়া রায় দিলেন। জগমোহনের পক্ষের আইনজ্ঞরা আশা দিলেন এ রায় হাইকেটে টিকিবে না । জগমোহন বলিলেন, আমি আপিল করিব না । যে-ঠাকুরকে আমি মানি না। তাহাকেও আমি ফাকি দিতে পারিব না। দেবতা মানিবার মতো বুদ্ধি যাহাদের, দেবতাকে বঞ্চনা করিবার মতো ধর্মবুদ্ধিও তাঁহাদেরই। বন্ধুরা জিজ্ঞাসা করিল, খাইবে কী ? তিনি বলিলেন, কিছু না খাবার জোটে তো খাবি খাইব। এই মকদ্দমা জয় লইয়া আস্ফালন করা হরিমোহনের ইচ্ছা ছিল না । তার ভয় ছিল পাছে দাদার অভিশাপের কোনো কুফল থাকে। কিন্তু পুরন্দর একদিন চামারদের বাড়ি হইতে তাড়াইতে পারে নাই, সেই আগুন তার মনে জ্বলিতেছিল । কার দেবতা যে জাগ্ৰত এইবার সেটা তো প্ৰত্যক্ষ দেখা গেল । তাই পুরন্দর ভোরবেলা হইতে ঢাক-ঢোল আনাইয়া পাড়া মাথায় করিয়া তুলিল। জগমোহনের কাছে র্তার এক বন্ধু আসিয়াছিল, সে কিছু জানিত না । সে জিজ্ঞাসা করিল, ব্যাপারখানা কী হে ? জগমোহন বলিলেন, আজ আমার ঠাকুরের ধুম করিয়া ভাসান হইতেছে, তারই এই বাজনা। দুই দিন ধরিয়া পুরন্দর নিজে উদযোগ করিয়া ব্ৰাহ্মণভোজন করাইয়া দিল । পুরন্দর যে এই বংশের কুলপ্ৰদীপ, সকলে তাহা ঘোষণা করিতে লাগিল । দুই ভাইয়ে ভাগাভাগি হইয়া কলিকাতার ভদ্রাসন-বাটীর মাঝামাঝি প্রাচীর উঠিয়া গেল । ধর্ম সম্বন্ধে যেমনি হউক, খাওয়াপরা টাকাকড়ি সম্বন্ধে মানুষের একটা স্বাভাবিক সুবুদ্ধি আছে বলিয়া মানবজাতির প্রতি হরিমোহনের একটা শ্রদ্ধা ছিল। তিনি নিশ্চয় ঠাওরাইয়াছিলেন তার ছেলে এবার নিঃস্ব জগমোহনকে ছাড়িয়া অন্তত আহারের গন্ধে তার সোনার খাচাকলের মধ্যে ধরা দিবে। কিন্তু বাপের ধর্মবুদ্ধি ও কর্মবুদ্ধি কোনােটাই পায় নাই, শচীশ তার পরিচয় দিল। সে তার জ্যাঠার সঙ্গেই রহিয়া গেল । জগমোহনের চিরকাল শচীশকে এমনি নিতান্তই আপনার বলিয়া জানা অভ্যাস হইয়া গিয়াছিল যে আজ এই ভাগাভাগির দিনে শচীশ যে তারই ভাগে পড়িয়া গেল। ইহাতে র্তার কিছুই আশ্চর্য বোধ হইল की । কিন্তু হরিমোহন র্তার দাদাকে বেশ চিনিতেন। তিনি লোকের কাছে রটাইতে লাগিলেন যে শচীশকে আটকাইয়া জগমোহন নিজের অন্নবস্ত্রের সংস্থান করিবার কৌশল খেলিতেছেন । তিনি অত্যন্ত সাধু হইয়া প্রায় অশ্রুনেত্রে সকলকে বলিলেন, দাদাকে কি আমি খাওয়াপরার কষ্ট দিতে পারি ? কিন্তু তিনি আমার ছেলেকে হাতে রাখিয়া এই-যে শয়তানি চাল চালিতেছেন ইহা আমি কোনােমতেই সহিব না। দেখি তিনি কতবড়ো চালাক । কথাটা বন্ধুপরম্পরায় জগমোহনের কানে যখন পৌঁছিল তখন তিনি একেবারে চমকিয়া উঠিলেন। এমন কথা যে উঠিতে পারে তাহা তিনি ভাবেন নাই বলিয়া নিজেকে নির্বোিধ বলিয়া ধিক্কার দিলেন। ‘শচীশকে বলিলেন, গুডবাই শচীশ ! ! শচীশ বুঝিল, যে বেদনা হইতে জগমোহন এই বিদায়বাণী উচ্চারণ করিয়াছেন তার উপরে আর কথা চলিবে না । আজ আঠারো বৎসর আজন্মকালের নিরবচ্ছিন্ন সংস্রব হইতে শচীশকে বিদায় লইতে হইল । শচীশ যখন তার বাক্স ও বিছানা গাড়ির মাথায় চাপাইয়া দিয়া তার কােছ হইতে চলিয়া গোল জগমোহন দরজা বন্ধ করিয়া তার ঘরের মধ্যে মেঝের উপর শুইয়া পড়লেন। সন্ধ্যা হইয়া গেল, তার পুরাতন চাকর ঘরে আলো দিবার জন্য দরজায় ঘা দিল— তিনি সাড়া দিলেন না। হার রে, প্রচুরতম মানুষের প্রভূততম সুখসাধন ! মানুষের সম্বন্ধে বিজ্ঞানের পরিমাপ যে খাটে না।