পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৪৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চতুরঙ্গ । 89 র বাপ ছিলেন, বন্ধু ছিলেন, আবার ছেলেও ছিলেন বলিতে পারা যায়। কেননা নিজের সম্বন্ধে তিনি এমন ভোলা এবং সংসার সম্বন্ধে এমন অবুঝ ছিলেন যে, তাকে সকল মুশকিল হইতে বাচাইয়া চলা শচীশের এক প্রধান কাজ ছিল। এমনি করিয়া জ্যাঠামশাইয়ের ভিতর দিয়াই শচীশ আপনার | যাহা-কিছু পাইয়াছে এবং তঁর মধ্য দিয়াই সে আপনার যাহা-কিছু দিয়াছে। তার সঙ্গে বিচ্ছেদের শূন্যতা প্রথমটা শচীশের কাছে যে কেমনতরো ঠেকিয়াছিল তা ভাবিয়া ওঠা যায় না। সেই অসহ্য যন্ত্রণার দায়ে শচীশ কেবলই বুঝিতে চেষ্টা করিয়াছিল যে, শূন্য এত শূন্য কখনােই হইতে পারে না ; সত্য নাই। এমন ভয়ংকর ফাকা কোথাও নাই ; এক ভাবে যাহা ‘না’ আর-এক ভাবে তাহা যদি ‘ই’ না হয় তবে সেই ছিদ্ৰ দিয়া সমস্ত জগৎ যে গলিয়া ফুরাইয়া যাইবে । । দুই বছর ধরিয়া শচীশ দেশে দেশে ফিরিল, তার কোনাে খােজ পাইলাম না। আমাদের দলটিকে লইয়া আমরা আরো জোরের সঙ্গে কাজ চালাইতে লাগিলাম। যারা ধর্মনাম দিয়া কোনাে একটা-কিছু মানে আমরা গায়ে পড়িয়া তাহাদিগকে হাড়ে হাড়ে জ্বালাইতে লাগিলাম, এবং বাছিয়া বাছিয়া এমন-সকল ভালো কাজে লাগিয়া গেলাম যাহাতে দেশের ভালোমানুষের ছেলে আমাদিগকে ভালো কথা না বলে। শচীশ ছিল আমাদের ফুল, সে যখন সরিয়া দাড়াইল তখন নিতান্ত কেবল আমাদের কঁটাগুলো উগ্র এবং উলঙ্গ হইয়া উঠিল । V) দুই বছর শচীশের কোনো খবর পাইলাম না। শচীশকে একটুও নিন্দা করিতে আমার মন সরে না, কিন্তু মনে মনে এ কথা না ভাবিয়া থাকিতে পারিলাম না যে, যে সুরে শচীশ বাধা ছিল এই নাড়া খাইয়া তাহা নামিয়া গেছে। একজন সন্ন্যাসীকে দেখিয়া একবার জ্যাঠামশায় বলিয়াছিলেন ; সংসার মানুষকে পোদারের মতো বাজাইয়া লয়, শোকের ঘা, ক্ষতির ঘা, মুক্তির লোভের ঘা দিয়া। যাদের সুর দুর্বল পোদ্দার তাহাদিগকে টান মারিয়া ফেলিয়া দেয় ; এই বৈরাগীগুলো সেই ফেলিয়া-দেওয়া মেকি টাকা, জীবনের কারবারে অচল। অথচ এরা জাক করিয়া বেড়ায় যে এরাই সংসার ত্যাগ করিয়াছে। যার কিছুমাত্র যোগ্যতা আছে সংসার হইতে তার কোনোমতে ফাঁসকাইবার জো নাই। শুকনো পাতা গাছ হইতে ঝরিয়া পড়ে, গাছ তাকে ঝরাইয়া ফেলে বলিয়াই- সে যে আবর্জনা | এত লোক থাকিতে শেষকালে শচীশই কি সেই আবৰ্জনার দলে পড়িল ? শোকের কালো। কষ্টিপাথরে এই কথাটা কি লেখা হইয়া গেল যে, জীবনের হাটে শচীশের কোনো দর। নাই ? এমন সময় শোনা গেল চাটগায়ের কাছে কোন-এক জায়গায় শচীশ- আমাদের শচীশ— একদিন কোনােমতে ভাবিয়া পাই নাই শচীশের মতো মানুষ কেমন করিয়া নাস্তিক হইতে পারে, । আজ কিছুতে বুঝিতে পারিলাম না লীলানন্দস্বামী তাহাকে কেমন করিয়া নাচাইয়া লইয়া বেড়ায়। এদিকে, আমরা মুখ দেখাই কেমন করিয়া ? শত্রুর দল যে হাসিবে । শত্ৰু তো এক-আধা জন নয়। দলের লোক শচীশের উপর ভয়ংকর চটিয়া গেল। অনেকেই বলিল, তারা প্রথম হইতেই স্পষ্ট জানিত শচীশের মধ্যে বস্তু কিছুই নাই, কেবল ফাঁকা ভাবুকত.। আমি যে শচীশকে কতখানি ভালোবাসি এবার তাহা বুঝিলাম। আমাদের দলকে সে যে এমন । করিয়া মৃত্যুবাণ হানিল, তবু কিছুতে তার উপর রাগ করিতে পারিলাম না। 8 গেলাম। লীলানন্দস্বামীর খোজে। কত নদী পার হইলাম, মাঠ ভাঙিলাম, মুদির দােকানে রাত কটাইলাম, অবশেষে এক গ্রামে গিয়া শচীশকে ধরিলাম। তখন বেলা দুটাে হইবে । ) ইচ্ছা ছিল শচীশকে একলা পাই। কিন্তু জো কী ! যে শিষ্যবাড়িতে স্বামীজি আশ্রয় লইয়াছেন তার