পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৭৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চতুরঙ্গ 8\ጋó গানের সুর করিয়া তুলিলেন। আর, আমার মতো সামান্য মানুষের উপর তিনি কী পরশমণি ছোয়াইয়া দিলেন আমি এক মুহুর্তে অসামান্য হইয়া উঠিলাম। যখন আড়াল থাকে তখন অনন্তকালের ব্যবধান, যখন আড়াল ভাঙে তখন সে এক নিমেষের পাল্লা । আর দেরি হইল না । দামিনী বলিল, আমি একটা স্বপ্নের মধ্যে ছিলাম, কেবল এই একটা ধাক্কার অপেক্ষা ছিল । আমার সেই-তুমি আর এই তুমির মাঝখানে ওটা কেবল একটা ঘোর আসিয়াছিল । আমার গুরুকে আমি বার বার প্রণাম করি, তিনি আমার এই ঘোর ভাঙাইয়া দিয়াছেন। আমি দামিনীকে বলিলাম, দামিনী, তুমি অত করিয়া আমার মুখের দিকে চাহিয়ে না। বিধাতার এই সৃষ্টিটা যে সুদৃশ্য নয় সে তুমি পূর্বে একদিন যখন আবিষ্কার করিয়াছিলে তখন সহিয়াছিলাম, কিন্তু এখন সহ্য করা ভারি শক্ত হইবে । দামিনী কহিল, বিধাতার ঐ সৃষ্টিটা যে সুদৃশ্য, আমি সেইটেই আবিষ্কার করিতেছি। আমি কহিলাম, ইতিহাসে তোমার নাম থাকিবে । উত্তরমেরুর মাঝখানটাতে যে দুঃসাহসিক আপনার নিশান গাড়িবে তার কীর্তিও এর কাছে তুচ্ছ। এ তো দুঃসাধ্যসাধন নয়, এ যে অসাধ্যসাধন । ফাল্লুন মাসটা এমন অত্যন্ত ছােটাে তাহা ইহার পূর্বে কখনো এমন নিঃসংশয়ে বুঝি নাই। কেবলমাত্র ত্ৰিশটা দিন, দিনগুলাও চব্বিশ ঘণ্টার এক মিনিট বেশি নয়। বিধাতার হাতে কাল অনন্ত, তবু এমনতরো বিশ্ৰী রকমের কৃপণতা কেন আমি তো বুঝিতে পারি না। দামিনী বলিল, তুমি যে এই পাগলামি করিতে বসিলে তোমার ঘরের লোক— । আমি বলিলাম, তারা আমার সুহৃদ। এবার তারা আমাকে ঘর থেকে দূর করিয়া তাড়াইয়া দিবে। তার পর ? ፭তার পরে তোমায় আমায় মিলিয়া একেবারে বুনিয়াদ হইতে আগাগোড়া নূতন করিয়া ঘর বানাইব, সে কেবল আমাদের দুজনের সৃষ্টি । দামিনী কহিল, আর, সেই ঘরের গৃহিণীকে একেবারে গোড়া হইতে বানাইয়া লইতে হইবে । সেও তোমারই হাতের সৃষ্টি হােক, পুরানো কালের ভাঙাচােরা তার কোথাও কিছু না থাক । চৈত্রমাসে দিন ফেলিয়া একটা বিবাহের বন্দোবস্ত করা গেল। দামিনী আবদার করিল, শচীশকে আনাইতে হইবে । আমি বলিলাম, কেন ? তিনি সম্প্রদান করিবেন । সে পাগলা যে কোথায় ফিরিতেছে তার সন্ধান নাই। চিঠির পর চিঠি লিখি, জবাবই পাই না । নিশ্চয়ই এখনো সেই ভূতুড়ে বাড়িতেই আছে, নহিলে চিঠি ফেরত আসিত। কিন্তু সে কারও চিঠি খুলিয়া পড়ে কি না সন্দেহ। আমি বলিলাম, দামিনী, তোমাকে নিজে গিয়া নিমন্ত্রণ করিয়া আসিতে হইবে, ‘পত্রের দ্বারা নিমন্ত্রণ— ত্রুটি মার্জনা' এখানে চলিবে না। একলাই যাইতে পারিতাম, কিন্তু আমি ভিতু মানুষ। সে হয়তো এতক্ষণে নদীর ও পারে গিয়া চক্ৰবাকদের পিঠের পালক সাফ করা তদারক করিতেছে, সেখানে তুমি ছাড়া যাইতে পারে এমন বুকের পাটা। আর কারো নাই। Y দামিনী হাসিয়া কহিল, সেখানে আর কখনো যাইব না প্ৰতিজ্ঞা করিয়াছিলাম। আমি বলিলাম, আহার লইয়া যাইবে না। এই প্ৰতিজ্ঞা ; আহারের নিমন্ত্রণ লইয়া যাইবে না কেন ? এবারে কোনোরকম দুর্ঘটনা ঘটিল না। দুইজনে দুই হাত ধরিয়া শচীশকে কলিকাতায় গ্রেপ্তার করিয়া আনিলাম। ছােটাে ছেলে খেলার জিনিস পাইলে যেমন খুশি হয় শচীশ আমাদের বিবাহের ব্যাপার লইয়া তেমনি খুশি হইয়া উঠিল। আমরা ভাবিয়াছিলামচুপচাপ করিয়া সারিব, শচীশ কিছুতেই তা হইতে দিল না। বিশেষত জ্যাঠামশায়ের সেই মুসলমানপাড়ার দল যখন খবর পাইল তখন তারা এমনি হল্লা করিতে লাগিল যে, পাড়ার লোকে ভাবিল কাবুলের আমির আসিয়াছে বা অন্তত 84 VOO