পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৩৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ঘরে-বাইরে (፩Sዓ সন্দীপ বললেন, তোমার বায়নার আশায় আমরা বসে নেই। আমাদের নিকড়িয়া উৎসব কড়ি দিয়ে কিনতে হবে না। ’ বলে তিনি তার ভাঙা মোটা গলায় গান ধরলেন - নিকড়িয়া বীশের বাঁশি বাজায় মোহন সুরে। আমার দিকে চেয়ে হেসে বললেন, মঙ্গীরানী, গান যখন প্ৰাণে আসে তখন গলা না থাকলেও যে বাধে না এইটে প্রমাণ করে দেবার জন্যেই গাইলুম। গলার জোরে গাইলে গানের জোর হালকা হয়ে যায়। আমাদের দেশে হঠাৎ ভরপুর গান এসে পড়েছে, এখন নিখিল বসে বসে গোড়া থেকে সারগম সাধিতে থাকুক, ইতিমধ্যে আমরা ভাঙা গলায় মাতিয়ে তুলব। আমার ঘর বলে, তুই কোথায় যাবি, বাইরে গিয়ে সব খোয়াবি- “ আমার প্রাণ বলে, তোর যা আছে সব যাক-না উড়ে পুড়ে । مجھے আচ্ছা, নাহয় আমাদের সর্বনাশই হবে, তার বেশি তো নয় ? রাজি আছি, তাতেই রাজি আছি। ওগো, যায়। যদি তো যাক-না চুকে, সব হারাব হাসিমুখে, আমি এই চলেছি মরণসুধা নিতে পরান পুরে । আসল কথা হচ্ছে নিখিল, আমাদের মন ভুলেছে, আমরা সুসাধ্য-সাধনের গণ্ডির মধ্যে টিকতে পারব না, আমরা অসাধ্য-সাধনের পথে বেরিয়ে পড়ব । ওগো, আপনি যারা কাছে টানে এ রস তারা কেই বা জানে, আমার বঁাকা পথের বঁাকা সে যে - ডাক দিয়েছে দূরে। এবার বঁাকার টানে সোজার বোঝা পড়ুক ভেঙে চুরে । মনে হল আমার স্বামীর কিছু বলবার আছে, কিন্তু তিনি বললেন না, আন্তে আস্তে চলে গেলেন। সমস্ত দেশের উপর এই যে একটা প্রবল আবেগ হঠাৎ ভেঙে পড়ল, ঠিক এই জিনিসটাই আমার জীবনের মধ্যে আর-এক সুর নিয়ে ঢুকেছিল। আমার ভাগ্যদেবতার রথ আসছে, কোথা থেকে তার সেই চাকার শব্দে দিনরাত্রি আমার বুকের ভিতর গুর-গুর করছে। প্রতি মুহুর্তে মনে হতে লাগল একটা-কী পরমাশ্চর্য এসে পড়ল বলে, তার জন্যে আমি কিছুমাত্র দায়ী নই। পাপ ? যে ক্ষেত্রে । পাপ-পূণ্য, যে ক্ষেত্রে বিচার-বিবেক, যে ক্ষেত্রে দয়া-মায়া, সে ক্ষেত্র থেকে সম্পূর্ণ সরে যাবার পথ হঠাৎ আপনিই যে খুলে গেছে। আমি তো একে কোনোদিন কামনা করিনি, এর জন্যে প্রত্যাশা করে বসে থাকি নি, আমার সমস্ত জীবনের দিকে তাকিয়ে দেখো এর জন্যে আমার তো কোনো জবাবদিহি নেই। এতদিন একমনে আমি যার পূজা করে এলুম, বর দেবার বেলা এ যে এল আর-এক দেবতা ! তাই, সমস্ত দেশ যেমন জেগে উঠে সম্মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বলে উঠেছে। “বন্দে মাতরং আমার প্ৰাণ তেমনি করে তার সমস্ত শিরা-উপশিরার কুহরে। কুহরে। আজ বাজিয়ে তুলেছে। “বন্দেী- কোন অজানাকে, অপূর্বক, কোন সকল সৃষ্টি-ছাড়াকে । দেশের সুরের সঙ্গে আমার জীবনের সুরের অদ্ভুত এই মিল! এক-একদিন অনেক রাত্রে আস্তে আস্তে আমার বিছানা থেকে উঠে খােলা ছাদের উপর দাঁড়িয়েছি। আমাদের বাগানের পঁচিল পেরিয়ে আধাপাকা ধানের খেত, তার উত্তরে গ্রামের ঘন গাছের ফাকের ভিতর দিয়ে নদীর জল এবং তারও