পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৬৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(፩ \ኃO রবীন্দ্র-রচনাবলী দিয়ে মুখ চেপে ধরে ফুপিয়ে কঁদিতে লাগলুম। মাঝে মাঝে আমার পায়ের উপর অমূল্যের করুণ হাতের স্পর্শ যতই পাই আমার কান্না ততই ফেটে পড়তে চায় । খানিকক্ষণ পরে সামলে উঠে চোখ খুলে দেখি যেন একেবারে কিছুই হয় নি এমনিভাবে সন্দীপ টেবিলের কাছে বসে গিনিগুলো রুমালে বাধছে। অমূল্য আমার পায়ের কাছ থেকে উঠে দাড়ালো, ছলছল করছে তার চোখ ; সন্দীপ অসংকোচে আমাদের মুখের দিকে চোখ তুলে বললে, ছ হাজার টাকা । অমূল্য বললে, এত টাকা তো আমাদের দরকার নেই সন্দীপবাবু ! হিসেব করে দেখেছি, সাড়ে তিন হাজার টাকা হলেই আমাদের এখনকার কাজ উদ্ধার হবে । সন্দীপ বললে, আমাদের কাজ তো কেবলমাত্ৰ এখনকার কাজই নয় । আমাদের যা দরকার তার কি সংখ্যা আছে ? অমূল্য বললে, তা হােক, ভবিষ্যতে যা দরকার হবে তার জনো আমি দায়ী, আপনি ঐ আড়াই হাজার টাকা রানীদিদিকে ফিরিয়ে দিন । সন্দীপ আমার মুখের দিকে চাইলে । আমি বলে উঠলুম, না না, ও টাকা আমি আর ষ্টুতে ও চাই নে। ও নিয়ে তোমাদের যা-খুশি তাই করে । সন্দীপ অমূল্যর দিকে চেয়ে বললে, মেয়েরা যেমন করে দিতে পারে এমন কি পুরুষ পারে % অমূল্য উচ্ছসিত হয়ে বললে, মেয়েরা যে দেবী ! সন্দীপ বললে, আমরা পুরুষরা বড়ো জোর আমাদের শক্তিকে দিতে পারি, মেয়েরা যে আপনাকে দেয় । ওরা আপনার প্রাণের ভিতর থেকে সন্তানকে জন্ম দেয়, পালন করে, বাহির থেকে নয়। এই দানই তো সত্য দান । এই বলে সন্দীপ আমার দিকে চেয়ে বললে, রানী, আজ তুমি যা দিলে এ যদি কেবলমাত্র টাকা হত তা হলে আমি এ ছুতুম না, তুমি আপনার প্রাণের চেয়ে বড়ো জিনিস দিয়েছ । মানুষের বোধ হয় দুটাে বুদ্ধি আছে । আমার একটা বৃদ্ধি বুঝতে পারে সন্দীপ আমাকে ভোলাচ্ছে, কিন্তু আমার আর-একটা বুদ্ধি ভোলে ; সন্দীপের চরিত্র নেই, সন্দীপের শক্তি আছে । সেইজনো ও যে মুহুর্তে প্রাণকে জাগিয়ে তোলে সেই মুহুর্তেই মৃত্যুবাণও মারে। দেবতার অক্ষয় তৃণ ওব হাতে আছে, কিন্তু তুণের মধ্যে দানবের অস্ত্ৰ । সন্দীপের রুমালে সব গিনি ধরছিল না ; সে বললে, রানী, তোমার একখানি রুমাল আমাকে দিতে পাৱ ? কাছে বসে পড়ে আমাকে প্ৰণাম করে বললে, দেবী, তোমাকে এই প্ৰণামটি দেবার জনোই ছুটে এসেছিলুম, তুমি আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিলে । তোমার ঐ ধাক্কাই আমার কর । ঐ ধাক্কা আমি মাথায় করে নিয়েছি । বলে মাথায় যেখানে লেগেছিল সেইখানটা আমাকে দেখিয়ে দিলে । আমি কি সত্যি ভুল বুঝেছিলুম ? সন্দীপ কি দুই হাত বাড়িয়ে দিয়ে তখন আমাকে প্ৰণাম করতেই এসেছিল ? তার মুখে চােখে হঠাৎ যে মত্ততা ফেনিয়ে উঠল। সে তো, মনে হল, অমূল্যও দেখতে পেয়েছিল । কিন্তু স্তবগানে সন্দীপ এমন আশ্চর্য সুর লাগাতে জানে যে তর্ক করতে পারি নে, সত্য দেখবার চোখ যেন কোন আফিমের নেশায় বুজে আসে ৷ সন্দীপকে আমি যে আঘাত করেছি। সে আঘাত সে আমাকে দ্বিগুণ করে ফিরিয়ে দিলে, তার মাথার ক্ষত আমার বুকের ভিতরে রক্তপাত করতে লাগল। সন্দীপের প্রণাম যখন পেলুম আমার চুরি তখন মহিমান্বিত হয়ে উঠল। টেবিলের উপরকার গিনিগুলি সমস্ত লোকনিন্দাকে, ধর্মবুদ্ধির সমস্ত বেদনাকে উপেক্ষা করে ঝক ঝক করে হাসতে লাগিল । আমারই মতো আমূল্যেরও মন ভুলে গেল। ক্ষণকালের জন্যে সন্দাপের প্রতি তার যে শ্রদ্ধা প্রতিরুদ্ধ হয়েছিল সে আবার বাধামুক্ত হয়ে উছলে উঠল, আমার পূজায় এবং সন্দীপের পূজায় তার হৃদয়ের