পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬২৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

V NRNR রবীন্দ্র-রচনাবলী করিতে চায়। প্রকৃতিতে আমরা দেখি, ব্যাপ্ত হইবার জন্য, টিকিয়া থাকিবার জন্য, প্রাণীদের মধ্যে সর্বদা একটা চেষ্টা চলিতেছে। যে জীব সস্তানের দ্বারা আপনাকে যত বহুগুণিত করিয়া যত বেশি জায়গা জুড়িতে পারে, তাহার জীবনের অধিকার তত বেশি বাড়িয়া যায়, নিজের অস্তিত্বকে সে যেন তত অধিক সত্য করিয়া তোলে । মানুষের মনোভাবের মধ্যেও সেই রকমের একটা চেষ্টা আছে। তফাতের মধ্যে এই যে, প্ৰাণের অধিকার দেশে ও কালে, মনোভাবের অধিকার মনে এবং কালে । মনোভাবের চেষ্টা বহু কাল ধরিয়া বহু মনকে আয়ত্ত করা । এই একান্ত আকাঙক্ষায় কত প্রাচীন কাল ধরিয়া কত ইঙ্গিত, কত ভাষা, কত লিপি, কত পাথরে খোদাই, ধাতুতে ঢালাই, চামড়ায় বাধাই— কত গাছের ছালে, পাতায়, কাগজে, কত তুলিতে, খোস্তায়, কলমে, কত আঁকজোক, কত প্ৰয়াস— বা দিক হইতে ডাহিনে, ডাহিন দিক হইতে বায়ে, উপর হইতে নীচে, এক সার হইতে অন্য সারে !! কী ? না, আমি যাহা চিন্তা করিয়াছি, আমি যাহা অনুভব করিয়াছি, তাহা মরিবে না ; তাহা মন হইতে মনে, কাল হইতে কালে চিন্তিত হইয়া, অনুভূত হইয়া প্রবাহিত হইয়া চলিবে । আমার বাড়িঘর, আমার আসবাব-পত্র, আমার শরীর-মন, আমার সুখদুঃখের সামগ্ৰী, সমস্তই যাইবে কেবল আমি যাহা ভাবিয়াছি, যাহা বোধ করিয়াছি, তাহা চিরদিন মানুষের ভাবনা, মানুষের বুদ্ধি আশ্রয় করিয়া সজীব সংসারের মাঝখানে বঁাচিয়া থাকিবে । মধ্য-এশিয়ায় গােবি-মরুভূমির বালুকাস্তুপের মধ্য হইতে যখন বিলুপ্ত মানবসমাজের বিস্মৃতি প্রাচীনকালের জীর্ণ পুঁথি বাহির হইয়া পড়ে তখন তাহার সেই অজানা ভাষার অপরিচিত অক্ষরগুলির মধ্যে কী একটি বেদনা প্রকাশ পায় ! কোন কালের কোন সজীব চিত্তের চেষ্টা আজ আমাদের মনের মধ্যে প্ৰবেশলাভের জন্য আঁকুৰ্বাকু করিতেছে! যে লিখিয়াছিল। সে নাই, যে লোকালয়ে লেখা হইয়াছিল তাহাও নাই ; কিন্তু মানুষের মনের ভাবটুকু মানুষের সুখদুঃখের মধ্যে লালিত হইবার জন্য যুগ হইতে যুগান্তরে আসিয়া আপনার পরিচয় দিতে পারিতেছে না, দুই বাহু বাড়াইয়া মুখের দিকে চাহিতেছে । জগতের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ সম্রাট অশোক আপনার যে কথাগুলিকে চিরকালের শ্রুতিগোচর করিতে কোনোকালে মরিবে না, সরিবে না ; অনন্ত কালের পথের ধারে অচল হইয়া দাড়াইয়া নব নব যুগের পথিকদের কাছে এক কথা চিরদিন ধরিয়া আবৃত্তি করিতে থাকিবে। পাহাড়কে তিনি কথা কহিবার ভার দিয়াছিলেন । পাহাড় কালাকালের কোনো বিচার না করিয়া তাহার ভাষা বহন করিয়া আসিয়াছে। কোথায় অশোক, কোথায় পাটলিপুত্র, কোথায় ধৰ্মজাগ্ৰত ভারতবর্ষের সেই গৌরবের দিন । কিন্তু পাহাড় সেদিনকার সেই কথা-কয়টি বিস্মৃত অক্ষরে অপ্রচলিত ভাষায় আজও উচ্চারণ করিতেছে ; কতদিন অরণ্যে রোদন করিয়াছে ! অশোকের সেই মহাবাণীও কত শত বৎসর মানবহৃদয়কে বোবার মতো কেবল ইশারায় আহবান করিয়াছে! পথ দিয়া রাজপুত গেল, পাঠান গেল, মোগল গেল, বর্গির তরবারি বিদ্যুতের মতো ক্ষিপ্ৰবেগে দিগদিগন্তে প্রলয়ের কশাঘাত করিয়া গেল— কেহ তাহার ইশারায় সাড়া দিল না। সমুদ্রপরের যে ক্ষুদ্র দ্বীপের কথা অশোক কখনো কল্পনাও করেন নাই, তাহার শিল্পীরা পাষাণফলকে যখন তাহার অনুশাসন উৎকীর্ণ করিতেছিল, তখন যে দ্বীপের অরণ্যচারী ‘দ্রুয়িদ’গণ আপনাদের পূজার আবেগ ভাষাহীন প্রস্তরস্তুপে স্তম্ভিত করিয়া তুলিতেছিল, বহুসহস্ৰ বৎসর পরে সেই দ্বীপ হইতে একটি বিদেশী আসিয়া কালান্তরের সেই মুক ইঙ্গিতপাশ হইতে তাহার ভাষাকে উদ্ধার করিয়া লইলেন । রাজ চক্রবর্তী অশোকের ইচ্ছা এত শতাব্দী পরে একটি বিদেশীর সাহায্যে সার্থকতা লাভ করিল। সে ইচ্ছ। আর কিছুই নহে, তিনি যত বড়ো সম্রাটই হউন, তিনি কী চান কী না চান, তাহার কাছে কোনটা ভালো কোনটা মন্দ, তাহা পথের পথিককেও জানাইতে হইবে । তঁহার মনের ভাব এত যুগ ধরিয়া সকল মানুষের মনের আশ্রয় চাহিয়া পথপ্রান্তে দাড়াইয়া আছে। রাজচক্রবর্তীর