পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭২৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

१२० রবীন্দ্র-রচনাবলী ভূগোল ইতিবৃত্ত জীবজন্তু উদ্ভিদ মনুষ্য- তাহার কথা কাহিনী ধর্মসাহিত্য সম্বন্ধে সমস্ত রহস্য স্বচেষ্টায় উদঘাটন করিতে লেশমাত্র উৎসাহ বা কৌতুহল অনুভব করি না। যে দেশকে আক্রমণ করিতে হইবে সে দেশের সমস্ত তথ্যানুসন্ধান করা শত্রুপক্ষের কত আবশ্যক তাহা আমরা জানি ; আর, যে দেশের হিতসাধন করিতে হইবে সেই দেশকেই কি জানার কোনো প্রয়োজন নাই ? কিন্তু প্রয়োজনের কথা কেন তুলিব ? যাহারা দেশ শাসন করেন তাহারা প্রয়োজনের গরজে দেশের বৃত্তান্ত সংগ্রহ করেন, আর যাহারা দেশকে ভালোবাসেন বলিয়া থাকেন তাহদের কি ভালোবাসার গরজ নাই ? তাহারা কি দেশের অন্তঃপুরে নিজে প্রবেশ করিবেন না ? সেখানকার সমস্ত সংবাদের ভুসুকুম হ্রস্টােরর যুগের দিকে নিতান্ত লিঙ্কভাবে নাপায় নিবােহের মতে তাকাইয় বঙ্গীয় সাহিত্যপরিষৎ স্বদেশের ভাষাতত্ত্ব প্রাচীন সাহিত্য কথা এবং সমস্ত বিবরণ সংগ্ৰহ করিবার জন্য প্রস্তুত হইয়াছেন । দেশের হিতসাধনের ইহাই স্থায়ী ভিত্তিস্থাপন । এই কারণেই, সাহিত্যপরিষদের অস্তিত্ব সর্বসাধারণের নিকট উৎকটরূপে প্ৰকাশমান না হইলেও এই সভাকে আমি অন্তরের সহিত । শ্রদ্ধা করি । এক-এক বৎসরে পর্যায়ক্রমে বাংলার এক-এক প্রদেশে এই সভার সাংবাৎসরিক অধিবেশনের অনুষ্ঠান করিবার জন্য আমি কিছুকাল হইল প্রস্তাব করিয়াছিলাম ; সে প্রস্তাব পরিষৎ গ্ৰহণ করিয়াছিলেন । অদ্য বরিশাল সাহিত্য সম্মিলনের আহবানে সাহিত্যপরিষদের সেই প্ৰাদেশিক অধিবেশনের প্রথম আরম্ভ হওয়াতে আমি আশান্বিত হইয়াছি । যে প্রদেশে সাহিত্যপরিষদের সাংবাৎসরিক অধিবেশন হইবে প্রধানত সেই প্রদেশের উপভাষা ইতিহাস প্রাকৃতসাহিত্য লোকবিবরণ প্রভৃতি সম্বন্ধে তথ্যসংগ্রহ ও আলোচনা হইতে থাকিলে অধিবেশনের উদ্দেশ্য প্রচুররাপে সফল হইবে । সেখানকার প্রাচীন দেবালয় দিঘি ও ইতিহাসপ্রসিদ্ধ স্থানের ফোটােগ্রাফ এবং প্রাচীন-পুথি পুরালিপি প্রাচীন-মুদ্রা প্রভৃতি সংগ্ৰহ করিয়া প্রদর্শনী হইলে কত উপকার হইবে তাহা বলা বাহুল্য। এই উপলক্ষে স্থানীয় লোকপ্রচলিত যাত্রাগান প্রভৃতির আয়োজন করা কর্তব্য হইবে । কিন্তু সাংবাৎসরিক উৎসব উপলক্ষে এক দিনেই কাজ শেষ করিলে চলিবে না । বাংলাদেশের প্ৰত্যেক প্রদেশেই সাহিত্যপরিষদের একটি করিয়া শাখা স্থাপিত হওয়া আবশ্যক । এই-সকল শাখাসভা অন্যান্য সাধারণ বিষয়ের আলোচনা ছাড়া প্রধানত তন্নতন্নরূপে স্থানীয় সমস্ত বিবরণ এবং রক্ষণযোগ্য প্রাচীন পুঁথি ও ঐতিহাসিক সামগ্ৰী সংগ্ৰহ করিবেন। স্বদেশী বিবরণ। -সংগ্রহে আমি একদিন সাহিত্যপরিষদে ছাত্রগণকে আহবান করিয়াছিলাম । এইরূপে সাহিত্যপরিষদের ন্যায় প্রবীণমণ্ডলীকে অনুরোধ করিতে আমি সাহস করিয়াছিলাম। তখনো স্বদেশী আন্দোলনের সূত্রপাত হয় নাই । সেদিনকার অভিভাষণের’ উপসংহারে বলিয়াছিলাম, ‘জননী, সময় নিকটবতী হইয়াছে, স্কুলের ছুটি হইয়াছে, সভা ভাঙিয়ছে, এইবার তোমার কুটিরপ্রাঙ্গণের অভিমুখে তোমার ক্ষুধিত সন্তানের পদধ্বনি শোনা যাইতেছে, এখন বাজাও তোমার শঙ্খ, জ্বলো তোমার প্রদীপ- তোমার প্রসারিত শীতলপাটির উপরে আমাদের ছোটাে বড়ো সকল ভাইয়ের মিলনকে তোমার অশ্রুগদগদ আশীর্বাচনের দ্বারা সার্থক করিবার জন্য প্ৰস্তুত হইয়া থাকো ।” তখন আমাদের সময় যে কত নিকটবর্তী হইয়াছিল। তাহা আমাদের ভাগ্যবিধাতাই নিশ্চিতরূপে জানিতেছিলেন । কিন্তু এখনাে আমাদের গর্ব করিবার দিন আসে নাই, চেষ্টা করিবার দিন দেখা দিয়াছে মাত্র । যে-সকল কাজ প্রতিদিন করিবার এবং প্রতি মুহূর্তে বাহির হইতে যাহার পুরস্কার পাইবার নহে— যাহার প্রধান বাধা বাহিরের প্রতিকূলতা নহে, আমাদেরই জড়ত্ব, দেশের প্রতি আমাদেরই ১ দ্রষ্টব্য "ছাত্রদের প্রতি সম্ভাষণ' : আত্মশক্তি ; সুলভ সংস্করণ রবীন্দ্র-রচনাবলীর দ্বিতীয় খণ্ড