পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৬৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গ্রন্থপরিচয় । ዒ¢ዔ মহাকাব্যে নাটকে বা নভেলে যে আখ্যানবস্তু পাওয়া যায় তাহার নানা বৈচিত্ৰ্য আছে। কিন্তু সকল বৈচিত্র্যসত্ত্বেও সেই সমস্ত আখ্যানে একটি সাধারণ উপাদান দেখিতে পাই ; সেটি আর কিছু নয়, সংসারে ভালেমদের দ্বন্দ্ব। তাই রামায়ণে দেখিয়াছি রাম-রাবণের যুদ্ধ, মহাভারতে । দেখিয়াছি কুরু-পাণ্ডবের বিরোধ। কেবলই সমস্তই একটানা ভালো, কোথাও মন্দের কোনো কোনো বড়ো যজ্ঞে দেখি নাই । এতবড়ো মোটা কথাও যে আমাকে আজ বিশেষ করিয়া বলিতে হইতেছে। সেজন্য আমি সংকোচ বোধ করিতেছি। শিশুরা যে রূপকথা শোনে সেই রূপকথাতেও রাক্ষস আছে ; সেই । রাক্ষস শুদ্ধ সংযত হইয়া কেবলই মনুসংহিতা আওড়ায় না, সে বলে “হাঁউ মীউ খাউ মানুষের গন্ধ পাউ" । ধর্মনীতির দিক হইতে দেখিলে তাহার পক্ষে এমন কথা বলা নিঃসন্দেহই গুরুতর অপরাধ ; আশা করি। যাহারা এই সকল গল্প রচনা করিয়াছিল। তাহারা নরমাংসাশী ছিল না এবং : যাহারা এই-সব গল্প শোনে নরমাংসে তাহাদের স্পাহা বাড়ে না। তাই বলিতেছি, মানুষের গন্ধে গল্পের রাক্ষসের লুব্ধতা উদ্রেক হওয়া ধৰ্মশাস্ত্ৰমতে অপরাধ সন্দেহ নাই। কিন্তু মানুষের গন্ধে গল্পের রাক্ষসের ভ্রাতৃপ্ৰেম যদি জাগিয়া উঠিত এবং সে যদি সুমধুর স্বরে বলিয়া উঠিত ‘অহিংসা পরমো ধৰ্মঃ তবে সাহিত্যরসনীতি অনুসারে রাক্ষসের সে অপরাধ কিছুতে ক্ষমা করা চলিত না। কোনাে শিশুর কাছে ইহার পরীক্ষা করিয়া দেখিলেই এক মুহুর্তেই আমার কথা সপ্রমাণ হইবে। কিন্তু সেই শিশুই কি বড়ো হইয়া এম. এ. পাস করিবামাত্র গল্পের রাক্ষসটা মরাল ফিলজফির নীচে চাপা পড়িয়া সরু সুরে শান্তিশতক আওড়াইতে থাকিবে ? যাই হউক, সকল ভাষার সকল সাহিত্যেই ভালোমন্দ দুইরকম চরিত্রেরই মানুষ আসরে স্থান পায়। পুণ্যভূমি ভারতবর্ষেও সেইরূপ বরাবর চলিয়া আসিয়াছে। এইজন্যই ঘরে-বাইরে নভেলে যখন সন্দীপের অবতারণা করিয়াছিলাম তখন মুহুর্তের জন্যও আশঙ্কা করি নাই যে সেটা লইয়া আমাদের দেশের উপাধিধারী এত গণ্যমান্য লোকের কাছে আমাকে এমন জবাবদিহির দায়ে পড়িতে হইবে । এখন হইতে ভবিষ্যতে এই আশঙ্কা মনে রাখিব, কিন্তু স্বভাব সংশোধন করিতে । পারিব না ; কেননা আমাদের দেশের বর্তমান কাল ছাড়াও কাল আছে, এবং গণ্যমান্য লোক ছাড়াও লোক আছে, তাহারা নিশ্চয়ই রাক্ষসের মুখ হইতে এই অত্যন্ত নীতিবিরুদ্ধ কথা শুনিতে চায় : হাউ মাউ খাউ মানুষের গন্ধ পাউ! চন্দ্ৰবিন্দুর বাহুল্য প্রয়োগেও তাহারা বাংলাভাষা সম্বন্ধে উদবিগ্ন হইবে না। জানি আমাকে প্রশ্ন করা হইবে, সন্দীপ যত বড়ো মন্দ লোকই হউক তাহাকে দিয়া সীতাকে অপমান কেন ? আমি কৈফিয়ত-স্বরূপে বাল্মীকির দোহাই মানিব, তিনি কেন রাবণকে দিয়া সীতার অপমান ঘটাইলেন। তিনি তো অনায়াসেই রাবণকে দিয়া বলাইতে পারিতেন যে, মা লক্ষ্মী, আমি বিশ হাতে তোমার পায়ের ধূলা লইয়া দশ ললাটে তিলক কাটিতে আসিয়াছি। : বেদব্যাস কেন দুঃশাসনকে দিয়া জয়দ্রথকে দিয়া দ্ৰৌপদীকে অপমানিত করিয়াছেন ?? রাবণ রাবণের যোগ্যই কাজ করিয়াছে ; দুঃশাসন জয়দ্ৰথ যাহা করিয়াছে তাহা তাহাদিগকেই সাজে। তেমনি আমার মতে সন্দীপ সীতা সম্বন্ধে যাহা বলিয়াছে তাহা সন্দীপেরই যোগ্য, অতএব সে । কথা অন্যায় কথা বলিয়াই তাহা সংগত হইয়াছে। এবং সেই সংগতি সাহিত্যে নিন্দার বিষয় ८ ।। যদি আধুনিক কালের কোনাে উপাধিধারী এমন কথা গদ্যে বা পদ্যে বলিতে পারিতেন যে, রাবণের পক্ষে সীতাহরণ কাজটা অসংগত, মন্থরার পক্ষে রামের প্রতি ঈর্ষা অযথা, সূৰ্পণখার পক্ষে লক্ষ্মণের প্রতি অনুরাগের উদ্রেক অসম্ভব, তাহা হইলে নিশ্চয় কবিগুরু বিচারসভায় হাজির থাকিলেও নিরুত্তর থাকিতেন ; কেননা এমন সকল আলোচনা সাহিত্যসভায় চলিতে পারে। কিন্তু তাহা না বলিয়া ইহারা যদি বলিতেন এ-সকল বর্ণনা নিন্দনীয় কারণ ইহাতে সীতাকে রামকে