পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

br8 রবীন্দ্র-রচনাবলী বরজলাল বুড়া শুক্লকেশ, শুভ্ৰ উষ্ণীষ শিরে, বিনতি করি সবে সভার মাঝে আসন নিল ধীরে ধীরে । শিরা-বাহির-করা শীর্ণ করে তুলিয়া নিল তানপুর, ধরিল নতশিরে নয়ন মুদি ইমনকল্যাণ সুর । কঁপিয়া ক্ষীণ স্বর মরিয়া যায় বৃহৎ সভাগৃহকোণে, ক্ষুদ্র পাখি যথা ঝড়ের মাঝে উড়িতে নারে প্রাণপণে । বসিয়া বাম পাশে প্ৰতাপ রায় দিতেছে শত উৎসাহ‘আহাহা, বাহা বাহা !” কহিছে কানে, “গলা ছাড়িয়া গান গাহি ।” সভার লোকে সবে অন্যমন- কেহ বা কানাকানি করে, কেহ বা তোলে হাই, কেহ বা ঢোলে, কেহ বা চলে যায় ঘরে । ‘ওরে রে আয় লয়ে তামাকু পান” ভূত্যে ডাকি কেহ কয় | সঘনে পাখা নাডি কেহ বা বলে, “গরম আজি অতিশয় ।” করিছে আনাগোনা ব্যস্ত লোক, ক্ষণেক নাহি রহে চুপ ? নীরব ছিল সভা, ক্রমশ সেথা শব্দ ওঠে শতরূপ । বুড়ার গান তাহে ডুবিয়া যায়, তুফান-মাঝে ক্ষীণ তরী— কেবল দেখা যায় তানপুরায় আঙুল কঁপে থরাথরি। হৃদয়ে যেথা হতে গানের সুর উছসি উঠে নিজসুখে হেলার কলরব শিলার মতো চাপে সে উৎসের মুখে । কোথায় গান আর কোথায় প্ৰাণ দু দিকে ধায় দুই জনে, তবুও রাখিবারে প্রভুর মান বরাজ গায় প্ৰাণপণে । গানের এক পদ মনের ভ্ৰমে হারায়ে গোল কী করিয়াআবার তাড়াতাড়ি ফিরিয়া গাহে, লইতে চাহে শুধরিয়া । আবার ভুলে যায় পড়ে না। মনে, শরমে মস্তক নাড়ি আবার শুরু হতে ধরিল গান— আবার ভুলি দিল ছাড়ি । দ্বিগুণ থারথারি কঁপিছে হাত, স্মরণ করে গুরু দেবে | কণ্ঠ কঁাপিতেছে। কাতরে, যেন বাতাসে দীপ নেবে-নেবে । গানের পদ তবে ছাড়িয়া দিয়া রাখিল সুরটুকু ধরিসহসা হাহারবে উঠিল কঁাদি গাহিতে গিয়া হা-হা করি । কোথায় দূরে গেল সুরের খেলা, কোথায় তাল গেল ভাসি, কোলের সখী তানপুরার পরে রাখিল লজিত মাথা— ভূলিল শেখা গান, পড়িল মনে বাল্যক্ৰন্দনগাথা । নয়ন ছলছল, প্ৰতাপ রায় কর বুলায় তার দেহে— ‘আইস হেথা হতে আমরা যাই’ কহিল সকরুণ স্নেহে । শতেক-দীপ-জ্বালা নয়ন-ভরা ছাড়ি সে উৎসবঘর বাহিরে গেল দুটি প্রাচীন সখা ধরিয়া দুহু দোহা-কার । এখন আসিয়াছে নূতন লোক, ধরায় নব নব রঙ্গ !